দখল পুনরুদ্ধার

দখল পুনরুদ্ধার: স্বত্ব ও ঘোষণার মামলা

জমি-জমার আইন

সম্প্রতি ‘স্থাবর সম্পত্তি হতে দখলচ্যুত হলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার’’ এই শিরোনামে আমরা একটি অনুচ্ছেদ প্রকাশ করে ছিলাম যেখানে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অবলম্বনে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, কোন ব্যক্তি যদি তার সম্পত্তি হতে তার অসম্মতি এবং আইনানুগ পন্থা ব্যতিরেকে দখলচ্যুত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি কিভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় তার সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে। ৯ ধারায় আমরা দেখেছি দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করতে হলে বাদীকে শুধুমাত্র তার দখল দুঃখ ছিল, এটা প্রমাণ করাই যথেষ্ট; সে ক্ষেত্রে তার স্বত্ব অর্থাৎ মালিকানা ছিল কিনা সেটা প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল না। আমরা এও দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, কীভাবে এবং কত দিনের মধ্যে দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করতে হবে। বলাবাহুল্য যে, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুসারে, মামলা করতে হলে বাদীকে অবশ্যই হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হয়। কিন্তু কখনো কখনো বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে আমরা অনেকেই মামলা করতে পারি না। তাছাড়া জাতি হিসেবে আমাদের এমনিতেই শেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করতে পছন্দ করি। পরীক্ষার আগের রাত্রে পড়তে, চাঁদ রাতে ঈদের বাজার করতে, বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার লাস্ট ডেটে গিয়ে ব্যাংকে ভিড় জমানো ইত্যাদিতে তো আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে রপ্ত করে এখনো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি। সেই পরম্পরায় আমরা মামলা করার বেলায়ও আরও কিছুদিন দেখি করতে করতে তামাদির মেয়াদই পার করে ফেলি। অবশ্যই সবার কারণ একই থাকে না,কেউ অলসতা করে, কেউ বা যৌথ সম্পত্তির ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে করতে সময় পার করে ফেলেন, আবার মামলা পরিচালনার জন্য আর্থিক বিষয় বিবেচনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, কেউ বা ঘরোয়া ভাবে বা গ্রাম্য/স্থানীয় সালিশের মাধ্যমে সমঝোতা করার চেষ্টা করার জন্য দেরি করে ফেলা সহ নানাবিধ অনেকগুলো বিষয়ের কারণে আমরা অনেক সময় ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে পারিনা। তখন সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার অধীনে মামলা করার অধিকার হারিয়ে যায়।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় মামলা করতে না পারলে আমাদের করণীয় কি সেটি সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। শুরুতেই বলে রাখি, দখলচ্যুত হওয়ার ৬ মাস পার হয়ে গেলেও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারার অধীনে দেওয়ানী কার্যবিধি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা যায়।

 

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারায় স্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার সম্বন্ধে বলা হয়েছে, অর্থাৎ এখানে আলাদা করে স্বত্ব বা দখলের জন্য মামলা করার কথা বলা হয়নি। বরং, স্বত্ব এবং দখল উভয়ের জন্যই মামলা করতে পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে যে, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারায় মামলা করার সময় অবশ্যই এর সাথে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারাও সংযুক্ত করে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা মূলত ঘোষণামূলক মামলা বা declaration suit নামে পরিচিত। এই ধারায় মামলা করার মাধ্যমে আপনাকে উক্ত জমির স্বত্বাধিকারী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার হবে। আর ৮ ধারার মাধ্যমে আপনাকে আপনার মালিকানা এবং দখল পুনরুদ্ধার করে দেওয়া হবে।


এখন কথা হচ্ছে, কখন আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারায় মামলা করবেন?

  • প্রথমেই বলা হয়েছে যে, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় মামলা করতে না পারলে আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারায় মামলা করতে পারবেন।
  • আপনার জমির দলিলে কোন ভুলত্রুটি রয়েছে যা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সংশোধন করতে পারছেন না বা দলিল সংশোধনের মামলা করেও সংশোধন করতে পারছেন না তখন সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারায় মামলা করবেন।
  • আপনার খতিয়ানে আপনার নাম নেই অথবা খতিয়ান আপনার নাম আছে কিন্তু জমির পরিমাণে বা হিস্যায় কম উঠেছে, তখন আমরা জানি যে, খতিয়ানে যদি ভুল হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনাকে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। কিন্তু ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল নিজেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে আর মামলা নিতে চায় না। কারণ যতদিন ট্রাইব্যুনাল খোলা রাখা হয় ততদিনই মামলা আসতে থাকে, তাই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল মামলা নেয়া বন্ধ করে দেয়। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন আপনার জেলাতেও ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল হয়তোবা মামলা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বা শীঘ্রই দিবে। সেই ক্ষেত্রে খতিয়ান সংশোধন করতে হলে আপনাকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারায় মামলা করতে হবে।
  • তাছাড়া জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে অন্য কোন আইনে সরাসরি কোন প্রতিকার না পেলে আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারায় মামলা করবেন।

 

এবার আসুন কতদিনের মধ্যে মামলা করবেন। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় তো ৬ মাস সময় পেয়েছেন, যা খুব অল্প বলেই হয়ত মামলা করার সময় পাননি। কিন্তু, ৮ ধারায় সময় দেওয়া হয়েছে এক যুগ তথা ১২ বছর। আপনার জমির দখল বা স্বত্ব সংক্রান্ত কোন জটিলতা তৈরি হওয়ার দিন থেকে বা সমস্যা সম্বন্ধে জানার সময় থেকে তামাদি আইনের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ১২ বছরের মধ্যে আপনাকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৪২ ধারার অধীন মামলা করতে হবে। ভবিষ্যতে আমরা আরেকটি অনুচ্ছেদ লেখার চেষ্টা করব যেখানে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ এবং ৯ ধারার মধ্যে পার্থক্য গুলো স্পষ্ট আকারে তুলে ধরার জন্য যাতে ভবিষ্যতে কেউ তার সম্পত্তি থেকে দখলচ্যুত হলে বা সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতার পড়লে মামলা করার বিষয় ৮ এবং ৯ ধারার মধ্যে কোন কনফিউশন বা দ্বিধা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করে। অনেকেই ৮ ধারার মামলা ৯ ধারায় করে ফেলে আবার অনেকে উল্টোটাও করে ফেলে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.