মৌজা রেট

মৌজা রেটঃ কি, কেন, কিভাবে?

জমি-জমার আইন

আমরা যখন একটি জমি ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর করি তখন সেটি আমরা গ্রাম বা মফস্বলের জন্য সাধারণত সেটি উপজেলা বা থানা পর্যায়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থাকে সেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধন করে থাকে। শহর অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি জায়গার জন্য আলাদা আলাদা করে নির্দিষ্ট করা রয়েছে সাব রেজিস্ট্রি অফিস। এসব জানা কথা, তারপরও বলতে হয়, আমরা জমাজমিটি স্থানান্তর করে নিয়ে থাকি লিখিত এবং নিবন্ধিত উপায়ে। কেননা, এখন লিখিত এবং নিবন্ধিত না হলে কোন চুক্তির আইনানুগভাবে কোন ভিত্তি নেই। তাই, লিখিত হওয়ার পর নিবন্ধনের জন্য আমাদেরকে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে হবে।

এখন এই যে আমরা আদালতে মামলা করলে আমাদেরকে আদালতে কোর্ট ফি জমা দিতে হয়, ঠিক তেমনি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আমরা যখন একটি জমির হস্তান্তর দলিল করে থাকি সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। বিভিন্ন রকম জমির জন্য বিভিন্ন রকম এবং সরকার সময়ে সময়ে এই ফি পরিবর্তন করতে পারেন। যদিও কথায় কথায় আমরা রেজিস্ট্রেশন ফি বলে থাকি, আদতে তা শুধু রেজিস্ট্রেশন ফি নয়। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন ফি, ষ্ট্যাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার কর, উৎসে কর, ই ফি, এন ফি, এনএন ফি, কোর্ট ফি ইত্যাদির সম্পৃক্ততা। আজ আমরা রেজিস্ট্রেশন ফি বা খরচ নিয়ে আলোচনা করবো না, আজ আলোচনা করবো শুধু মৌজা রেট নিয়ে।

মৌজা বলতে আমরা এখন গ্রাম হিসেবে জানলেও মৌজা বলতে মূলত বুঝানো হতো, রাজস্ব আদায় করার জন্য সবচেয়ে ছোট একক। আমরা যেমন ওজনের দিক থেকে গ্রাম, দূরত্বের দিক থেকে কিলোমিটারকে একক ধরি, তেমনি রাজস্ব আদায়ের জন্য একক ধরা হতো মৌজাকে। এখন ধরুন, একটি মৌজাতে এক বছর যে পরিমাণ জমি একে অন্যকে মধ্যে ক্রয় বিক্রয় হয়েছে সেখানে হস্তান্তরের যে মূল্য রয়েছে সেই মূল্যের ভিত্তিতে মৌজার রেট নির্ধারণ করা হয়। এক বছরে একটি মজার মধ্যে ১০০ টি দলিল তৈরি করা হয়েছে এবং ১০০ টি দলিলে মোট হস্তান্তরিত সম্পত্তির মূল্য ছিল ১০০ কোটি টাকা আবার ১০০ টি দলিলে জমির পরিমাণ ছিল ১০,০০০ শতাংশ, সে ক্ষেত্রে ১০০ কোটি টাকাকে ১০,০০০ শতাংশ দিয়ে ভাগ করলে যা হবে তাই হচ্ছে শতাংশ প্রতি পরবর্তী বছরের জন্য ঐ মৌজার রেট। মৌজা রেট বলতে এক কথায় সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য।

সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বিধিমালা, ২০১০ এর ৫ বিধির পরিবর্তে বাজারমূল্য বিধিমালা সর্বশেষ সংশোধনী, ২০১৫ এর ৫ বিধি প্রতিস্থাপিত হয় যাতে বর্তমানে নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, এই বিধির অধীনে চূড়ান্ত হওয়া তালিকায় নির্ধারিত বাজারমূল্য পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য বাজার মূল্য হিসেবে কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ এখন থেকে বাজার মূল্য প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর নির্ধারণ করা হবে যেখানে উপর আমরা এক বছরের বাজার মূল্য নির্ধারণের উদাহরণ দেখিয়েছি। এই ক্ষেত্রে আরো স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, কমিটির সদস্য সচিব প্রতি দুই বছর অন্তর বাজার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথম বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এলাকার রেজিস্ট্রিকৃত সাব কবলা দলিল সমূহের মূল্যের উপর সংশ্লিষ্ট মৌজার শ্রেণীভিত্তিক গড় মূল্যের একটি তালিকা স্থাপন বা প্রস্তুত করবেন এবং উক্ত তালিকা দ্বিতীয় বছরের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কমিটির বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করবেন। এরপর কমিটি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সম্পত্তির বাজার মূল্য হালনাগাদ করে বাজার মূল্য নির্ধারণ করা সম্পর্কিত চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং এর একটি অনুলিপি দ্বিতীয় বছরের ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে মহাপরিদর্শকের নিকট পাঠাবেন। তবে, চুক্তির মামলায় ডিক্রি জারি কার্যক্রমের আওতায় আদালত কর্তৃক সম্পাদিত দলিলে প্রদর্শিত মূল্যের ভিত্তিতেই উক্ত দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে। কোন বায়না দলিলে সম্পত্তির মূল্য যেমনি উল্লেখ করা হোক না কেন উক্ত মূল্য যদি বাজারমূল্য হতে কম হয় তবে বিক্রয় দলিল সম্পাদনের সময় বিদ্যমান বাজারমূল্যের ভিত্তিতেই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। কিন্তু, মজার বিষয় হচ্ছে, বায়না দলিলে সম্পত্তির মূল্য যদি বর্তমান বাজার মূল্য থেকে বেশি থাকে সে ক্ষেত্রে বিক্রয় দলিল সম্পাদনের সময় বায়না দলিলের ভিত্তিতে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে (?)। আর কখনো যদি আপনি আপনার এলাকায় কোন জমির শ্রেণীর সর্বনিম্ন বাজার মূল্য তালিকায় না পান, সেই ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী মৌজার একশ্রেণীর বাজারমূল্যের ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এসব টেকনিক্যাল আলাপ ভালো নাও লাগতে পারে আপনার। আসুন এখন জেনে নেই, মৌজা রেটের ভিত্তিতে জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ বা ফি কিভাবে কত হয়। 



যদিও জমি রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়ে ভবিষ্যতে একটি বিষয় আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে তারপরও প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে এই অনুচ্ছেদে আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রি সম্বন্ধে আলোচনা করবো। সরকার সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় করে যে দলিলের মাধ্যমে সেটি হচ্ছে বিক্রয় দলিল বা সাফ কবলা দলিলের মাধ্যমে। কারণ নীচের ছকেই দেখে নিন।

ফিস বিষয়ক ফিসের হার টাকার অংকে
রেজিস্ট্রেশন ফি সম্পত্তির মোট মূল্যের ১% সম্পত্তির মূল্য যদি হয় ১ লক্ষ টাকা, তাহলে রেজিস্ট্রেশন ফি ১০০০ টাকা।
ষ্ট্যাম্প শুল্ক সম্পত্তির মোট মূল্যের ১.৫% সম্পত্তির মূল্য যদি হয় ৫ লক্ষ টাকা, তাহলে ষ্ট্যাম্প শুল্ক হবে ৭৫০০ টাকা।
স্থানীয় সরকার কর সম্পত্তির মোট মূল্যের ৩% সম্পত্তির মূল্য যদি হয় ২০ লক্ষ টাকা, তাহলে স্থানীয় সরকার কর হবে ৬০০০০ টাকা।
উৎসে কর পৌরসভার মধ্যে সম্পত্তির মোট মূল্যের ২%  সম্পত্তির মূল্য যদি হয় ১০ লক্ষ টাকা, তাহলে উৎসে কর হবে পৌরসভার মধ্যে ২০০০০ টাকা
ইউনিয়নের মধ্যে সম্পত্তির মোট মূল্যের ১% সম্পত্তির মূল্য যদি হয় ১০ লক্ষ টাকা, তাহলে উৎসে কর হবে ইউনিয়নের মধ্যে ১০০০০ টাকা।
ই ফি শতকরা হারে নয়, বরং নির্ধারিত। ১০০ টাকা
এন ফি শতকরা হারে নয়, বরং নির্ধারিত। বাংলায় পৃষ্ঠা প্রতি ১৬ টাকা আর ইংরেজিতে পৃষ্ঠা প্রতি ২৪ টাকা।
এনএন ফি শতকরা হারে নয়, বরং নির্ধারিত। বাংলায় পৃষ্ঠা প্রতি ২৪ টাকা আর ইংরেজিতে পৃষ্ঠা প্রতি ৩৬ টাকা।
হলফনামা ষ্ট্যাম্প শতকরা হারে নয়, বরং নির্ধারিত। ২০০ টাকা।
কোর্ট ফি শতকরা হারে নয়, বরং নির্ধারিত। ১০ টাকা

 

যদিও দান সংক্রান্ত হেবা দলিলের রেজিস্ট্রেশন ফি নেই সহ আরও অনেক ধরনের দলিল রয়েছে এবং রয়েছে মৌজা রেটের ভিত্তিতে তাদের রেজিস্ট্রেশন খরচের তারল্য। তবে, মৌজা রেট কি এবং সেটি কিভাবে নির্ধারণ করা হয় এবং সেটির ভিত্তিতে কিভাবে জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ নির্ধারিত হয়, সেটা সম্বন্ধে একটি ধারণা পেয়েছেন। পরবর্তী একটি পর্বে দেখানোর চেষ্টা করবো, মৌজা রেট আর জমির প্রকৃত মূল্য নিয়ে লুকোচুরি কে বা কারা করে এবং কেন করে। আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকবেন।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.