দেনমোহর পরিশোধে বাধ্যবাধকতা এবং কতিপয় ক্ষেত্রে ছাড়

দেনমোহর

সূরা আন নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে, মহান আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন, “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।”
অর্থাৎ স্ত্রীকে দেনমোহর দিতে হবে খুশি মনে আর স্ত্রী যদি সে অংশ ছেড়ে দেয়, সেটা আংশিক হতে পারে কিংবা সম্পূর্ণ হতে পারে; তবে তা স্বাচ্ছন্দ্যে স্বামী ভোগ করতে পারবে। এটি কিন্তু ফরজ এবং আল্লাহ্‌র আইন, যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত হয়েছে। আয়াতের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, তোমরা মোহর দাও খুশি মনে; কিন্তু আমাদের সমাজে মোহর খুশী দেওয়ার রেওয়াজ নেই। কারণ, এক পক্ষের খুশী আরেক পক্ষের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সমাজে বিয়েতে দেনমোহর নিয়ে বিবাদ লেগেই থাকে। এমন বিয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে দেনমোহর নিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তো বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরও শুধু দেনমোহর নির্ধারণ করতে না পারার জন্য বিয়ে ভেঙ্গে যায়।

এখানে উল্লেখ্য, দেনমোহরের পরিমাণ এবং বিস্তারিত যেহেতু কাবিননামায় লিপিবদ্ধ থাকে, সেহেতু অনেকেই দেনমোহরকে কাবিন বলেও আখ্যায়িত করে থাকে। দেখবেন বিয়ে বাড়িতে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে থাকে, ভাই কাবিন কত?- তিনি আসলে জানতে চাচ্ছেন, দেনমোহর কত? তাই এই বিষয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কিছু নেই; আঞ্চলিকতা বা প্রচলিত হওয়ার কারণে দুটোই এখন একই অর্থ বহন করে।

 

ব্যবসা বা রাজনীতিতে কোন চুক্তি স্বাক্ষর করার আগে উভয় পক্ষ হিসেব করে যে, চুক্তির বেটার পার্টে কে আছে, অর্থাৎ চুক্তিটি কার জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো। বিয়েও যেহেতু একটি চুক্তি তাই আমাদের মানসিকতাটা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বিয়েতেও আমরা কে বেটার পজিশনে আছে সেটা নির্ধারণ করি দেনমোহরের পরিমাণ দেখে। দেনমোহর যদি পরিমাণে কম হয়, তাহলে ছেলে বা বর পক্ষ চিন্তা করে, আমরা বিয়ে তথা চুক্তির বেটার পার্টে আছি। অন্য দিকে, দেনমোহরের পরিমাণ যদি বেশি হয়, তাহলে কনে বা মেয়ে পক্ষ খুশী থাকে এই ভেবে যে, এখন ছেলে পক্ষ উনিশ বিশ করতে পারবে না, করলেই দেনমোহরের চাপে সোজা হয়ে যাবে।

 

এখানে বলে রাখা ভালো যে, যে পক্ষই তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ করুক না কেন, ছেলেকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতেই হবে; এটা মাফ নেই। অনেকেরই প্রশ্ন থাকে যে, স্ত্রী নিজ ইচ্ছায় তালাক দিলে তারপরও কি তাকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে? উত্তর জি শুনে, তার অভিযোগ হচ্ছে, তাহলে তো অনেকেই বিয়েকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলবে। এটা শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবে এমনটা অনেকে জায়গায় ঘটার অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। এমন অভিযোগও শুনা যায় যে, স্ত্রী পরকীয়া করছে, স্বামী সেটি জানতে পেরেও স্ত্রীকে তালাক দিতে পারছে না, কারণ তার কাছে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই। তাই, দেনমোহর নির্ধারণের সময় নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সেটি ঠিক করা উচিত। একবার দেনমোহর নির্ধারণ করে বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর স্ত্রীর মাফ করা ব্যতীত দেনমোহর পরিশোধ থেকে আর রেহাই নেই। এমনকি যদি কেউ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করে মৃত্যুবরণ করে তবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে সেই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু, উপরে উল্লেখিত আয়াতের শেষ অংশ অনুসারে, স্ত্রী যদি স্বাচ্ছন্দ্যে দেনমোহরের কিছু অংশ বা পুরোটাই মাফ করে দেয়, সেক্ষেত্রে ছেলেকে ঐ অংশ বা পুরোটাই আর পরিশোধ করতে হবে না।

ব্যতিক্রম: বিয়ে হয়েছে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়নি, এর আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে (স্বামী বা স্ত্রী যে কারো মৃত্যুর মাধ্যমেও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে), তাহলে দেনমোহরের অর্ধেক অর্থ পরিশোধ করতে হবে। অনেকেরই প্রশ্ন থাকে, বিয়ে হয়েছে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার আগেই কি বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নাকি?- জি হয় ভাই। অনেক সময় দেখা যায় যে, বিয়ে হয়েছে কিন্তু স্ত্রীকে এখনো স্বামীর বাড়িতে নেওয়া হয়নি বা তারা একসাথে থাকা শুরু করেনি। আবার, ইমারজেন্সি বিদেশ যাওয়ার মুহূর্তে বিয়ে হয়েছে যার ফলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, আরও অনেক কারণেই হতে পারে। আর। মৃত্যুর মাধ্যমেও যেহেতু বিবাহের অবসান ঘটে তাই বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক সম্পন্ন হওয়ার আগেই যদি কারো মৃত্যু ঘটে তবে দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হবে। বিয়ে করে বউ নিয়ে বরের বাড়ি আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতেও দেখেছি আমরা, এমন ক্ষেত্রেও দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হবে। যদি স্বামী মারা যায় তবে তার সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করতে হবে আর যদি স্ত্রী মারা যায় তবে তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে তার উক্ত পাওনা পরিশোধ করতে হবে।

 

The Family Courts Ordinance, 1985 এর ৫ ধারা অনুযায়ী দেনমোহরের জন্য পারিবারিক আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে তামাদি আইন অনুসারে দেনমোহরের দাবি উত্থাপনকারীকে উক্ত দাবির কারণ উদ্ভবের কারণ থেকে ৩ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। এখন এই কারণ উদ্ভব হয় সাধারণত, তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর সময় থেকে।

 

যেতে যেতে উত্তরাধিকার আইনের একটি বিষয় উল্লেখ করে শেষ করছি, অনেক সময় দেখা যায় যে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে পেলে, তখন তাকে তার সাবেক স্বামীর সম্পত্তিকে অংশ দিতে অস্বীকার করা হয়, তার নতুন বিয়ের কারণ দেখিয়ে। জেনে রাখা ভালো, স্বামীর মৃত্যুর পর অন্যত্র বিয়ে করার পরও কিন্তু স্ত্রীলোকটি তার সাবেক স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পাবেন। পাশাপাশি যদি দেনমোহর অপরিশোধিত থাকে তাহলে তিনি তা ক্ষমাও করতে পারেন আবার ক্ষমা না করলে দেনমোহরের অর্থ অন্যান্য পাওনাদারের দায় হিসেবে আগে পরিশোধ করে তারপর উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ডিভোর্স ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে: আইন কি বলছে?

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?