বর্তমানে আমাদের দেশের ৬৪ টি জেলার পারিবারিক আদালতের চেহারা প্রায় একই রকম । প্রায় সব আদালতেই এখন এক ধরনের মামলাই সবচেয়ে সহজলভ্য আর টা হচ্ছে দেনমোহর আদায়ের মামলা । মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে , পারিবারিক আদালতে ৫ ধরনের ন্যায় বিচারের জন্য মানুষ যাবে তথা ৫ ধরনের দ্বন্দ্ব নিরসরে পারিবারিক আদালত মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকবে ।
এই ৫ ধরনের মামলা হচ্ছে (১) তালাক , (২) দেনমোহর , (৩) ভরণপোষণ , (৪) অভিভাবকত্ব , (৫) দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার।
কিন্তু আপনি আমি আজ গিয়ে পারিবারিক আদালতের নথি গণনা করে যদি দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে, তালাক, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব এবং দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এই চার ক্যাটাগরির মামলা একসাথে করলে যা হবে, তার সমান দেনমোহরের মামলা পাওয়া যাবে। ঠিক কাছাকাছি ততগুলো মামলা পাওয়া যাবে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে’; এমনটি নথি খুলে দেখলে হয়ত দেখা যাবে যে, বাদী বিবাদীর নাম ঠিকানা এবং মামলা ফাইলিং এর তারিখও একই।
এখন আসুন দেখি কেন এই দেনমোহরের মামলার এত হিড়িক? কেনই বা মানব সমাজের সবচেয়ে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের এমন অবক্ষয়?
মা হাওয়া আর বাবা আদমকে দিয়েই মানব সমাজের প্রথম পরিবারে পদার্পণ। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের আগমন। এখন পৃথিবীর কোণায় কোণায় মানুষ পরিবার গঠন করে বা কোন না কোন পরিবারের অংশ তথা সদস্য হয়ে বসবাস করেছে। স্বামী– স্ত্রী নিয়ে যে পরিবারের সূত্রপাত হয়েছিল , সন্তান সন্তানাদি নিয়ে সেই সংসার হয়ে উঠেছিল আনন্দময়। এক সময় সন্তান সন্তানাদির বিয়ের মাধ্যমে বাবা মা হয়ে যান শ্বশুর শাশুড়ি আর কিছুকাল পরে নানা নানী বা দাদা দাদী । এই ভাবেই পরিবারের শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি পায় আর শুরু হয় এক সংসারের সাথে অন্য সংসারের সম্পর্ক মিল বন্ধন।
দুটো মানুষ এক সাথে থাকলেও কত মতের মিল অমিল হয়ে থাকে। সেখানে দুটো পরিবার যখন এক সাথ হয় তখন কত মানুষ এক সাথে হচ্ছে একটি বিয়েকে কেন্দ্র করে, যত মানুষ তত মত, নানা মতে নানা সুবিধা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সমস্যাও। কিন্তু সমস্যা যখন সুবিধার চেয়ে যখন বেশি হয়ে যায়, ঠিক তখন মানুষ বেছে নেয় বিচ্ছেদ । ধর্মীয় দৃষ্টি কোণ থেকেও বিচ্ছেদকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে তবে সাথে তিরস্কার স্বরূপ বলে দেওয়া হয়েছে যে, তালাক হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল।
এবার আসুন দেনমোহর থেকে তালাকের দিকে মোড় নেওয়ার পিছনের কারণ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক। দেনমোহর বিয়ের একটি শর্তের মধ্যে পড়ে। মুসলিম আইন অনুসারে , একটি বিবাহ সম্পন্ন হতে হলে, প্রথমে এক পক্ষ প্রস্তাব দিতে হবে, অন্য পক্ষ সেটি গ্রহণ করতে হবে। সাক্ষী থাকতে হবে এবং বর কনেকে মোহরানা তথা দেনমোহর দিতে হবে। এই দেনমোহরকে আমরা আবার কাবিন হিসেবেও জানি। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই কাবিন তথা দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়, কেননা এটা কণের হক। কিন্তু আমাদের দেশে দেনমোহর বিবাহের সময় পরিশোধের কোন বালাই নেই। কাবিননামাতে যে পরিমাণ কাবিন বা দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করে, তার মধ্যে একটা ছোট অংশ উশুল হিসেবে ধরা হয়। বাকীটা বকেয়া থেকেই যায়। দেখা যায় যে, অনেক বর মারাও গেছে মোহরানার হক পরিশোধ না করে, যদিও তখন নিয়ম হচ্ছে ঐ লোকের সম্পত্তি বণ্টনের আগে তার স্ত্রীর মোহরানার হক পরিশোধ করা। কিন্তু আগের প্রজন্মের বেশির ভাগ মা খালা বা নানী দাদীরা এই মোহরানার হক তার স্বামীকে মাফ করে দিতে পারে। তবে স্বামীর দায়িত্ব হচ্ছে, স্ত্রীকে তার প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া, স্ত্রী পরবর্তীতে যদি খুশী মনে স্বামীকে তা ফেরত দিয়ে দেয়, তবে স্বামী তা পুনরায় আবার গ্রহণ করতে পারবেন। সবকিছু এত সুন্দর মতে চললে আদালতে এতো দেনমোহরের মামলা কেন?
যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন শুরু হতে না হতে একক পরিবার নিজেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। বাবা-মা, ভাই বোনকে বোঝা ভাবতে শুরু করতে যেখানে দুই যুগ পার হয়নি, সেখানে এখন স্বামী স্ত্রীকে বোঝা ভাবছে, স্ত্রী স্বামীকে। সন্তানদেরকে নিয়ে কোন চিন্তাই নেই। যেখানে এক সময় অল্প বয়সে এক বা দুই সন্তান নিয়ে বিধবা হয়ে যাওয়া বাঙালী নারীরা পুনরায় বিবাহ নিয়ে ভাবতে পারেনি, সেখানে আজ স্বামীকে তালাক দিয়ে পুনরায় বিবাহ একটা ফ্যাশনে রূপ নিচ্ছে। শুধু নারীকে দোষারোপ করাও অন্যায়, পুরুষও ধর্মীয় অনুশাসন মানতে ব্যর্থ। উভয়ের নৈতিক এবং ধর্মীয় অবক্ষয়ের ফলশ্রুতিতে সংসার তথা পরিবার আজ আদালত-মুখী।
সময় মত দেনমোহর পরিশোধ করা হচ্ছে না। সংসারে যেকোনো ইস্যু নিয়ে সমস্যা হোক, সেটা তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি বা সাংসারিক অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক ইন্ধন, তখনি মাথায় আসে কি করলে লাভ বেশী? সংসার টিকিয়ে রাখলে অশান্তি বেশীই , তার চেয়ে তালাকে কিছু নগদ অর্থও পাওয়া যাবে। ফলে তালাকেই তো ঝুঁকবে সবাই। আর তালাক দিলে ৯০ দিনের একটা সমঝোতার সুযোগ সালিশি পরিশোধকে বেধে দিলেও নেই কোন উদ্যোগ । আইনে সালিস পরিশোধকে সমঝোতার জন্য চেষ্টা করতে বললেও সালিসি পরিশোধ উভয় পক্ষকে ডেকেছে , এমন ঘটনাই বিরল। যার ফলে , সহজেই তালাক সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। আর তখন দেনমোহরের টাকা ঘরোয়া ভাবে চেয়েও যখন পাওয়া যায় না বা যখন ঘরোয়া ভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য থাকে না, তখন সংসারের আমলনামা খোলা হয় আদালতে। শুধু দেনমোহরের টাকার জন্য মামলা করলে সাবেক স্বামীর নামে ওয়ারেন্ট বের হতে সময় লাগবে, আর ওয়ারেন্ট না বের হলে স্বামী সহজে টাকা পরিশোধের জন্যও আগ্রহ প্রকাশ করবে না, তাই বাধ্য হয়ে দৌড়ের উপর রাখতে করা হয়, নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলা দিয়ে। আবার, সব মামলার কজ অফ একশন এটাই, তাও কিন্তু বলছি না।
আজ প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করছি। পরের পর্বগুলোতে আরও বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো সমাধানের উপায়সহ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )