চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে

বাংলাদেশে ব্যবসায়িক চুক্তি হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের একটি মূল ভিত্তি, যা দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে নির্দিষ্ট শর্তাবলীর অধীনে লেনদেন বা সেবা প্রদান সম্পর্কিত বিষয়ে একটি আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। চুক্তির মাধ্যমে পক্ষগণ তাদের অধিকার, দায়িত্ব এবং ঝুঁকিসমূহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়, যা ভবিষ্যতে কোনো বিভ্রান্তি বা বিরোধ এড়াতে সাহায্য করে। সাধারণত ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদিত হয়। যেমন, একজন রপ্তানিকারক বিদেশে পণ্য সরবরাহের জন্য একজন আমদানিকারকের সাথে চুক্তি করেন। আবার, একজন ঠিকাদার একটি নির্মাণ প্রকল্পের জন্য মালিকের সাথে চুক্তি করতে পারেন।

 

এই চুক্তিগুলো সাধারণত আইনজীবী, কর্পোরেট লিগ্যাল কনসালট্যান্ট বা প্রশিক্ষিত নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা হয়। তারা চুক্তির প্রতিটি ধারা ও শর্তাবলী সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে নিশ্চিত করেন যাতে চুক্তিটি আইনি বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যদি একটি সাপ্লাই চুক্তি করতে চান, তবে তিনি স্থানীয় একজন আইনজীবীর সহায়তা নেন, যিনি সেই চুক্তি লেখার কাজ সম্পন্ন করেন এবং চুক্তির সমস্ত আইনি দিকগুলো নিশ্চিত করেন। কখনো কখনো আমরা আইনজীবী, দলিল লেখক বা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা না নিয়ে নিজেরা নিজেরাই চুক্তিপত্র তৈরি করে থাকি। যেভাবেই চুক্তিপত্র তৈরি করুন না কেন, আপনাকে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যাতে উক্ত চুক্তিপত্র আপনাকে বিভিন্ন ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয় এবং উটকো ঝামেলায় না ফেলে। তো চলুন নিচের পয়েন্টগুলো পর্যালোচনা করে নিজের চুক্তি নিজে কিভাবে সাজাবেন, সেটাই দেখা যাক। 

১। ব্যবসায়িক চুক্তি সঠিকভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়াঃ চুক্তিটি এমনভাবে লিখতে হবে যাতে দুই পক্ষের মধ্যে যা কিছু আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে তা সঠিকভাবে উল্লেখ করা থাকে। যেমন, ব্যবসায়ী বা জমির লেনদেনের চুক্তিতে জমির পরিমাণ, মূল্য এবং মালিকানার শর্তাবলী সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। যদি চুক্তিতে এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে উল্লেখ না থাকে, তবে ভবিষ্যতে বিরোধ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কামাল এবং ফারুক নামে দুই ব্যক্তি ঢাকা শহরে একটি জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে চেয়েছেন। তারা জমির পরিমাণ, মূল্য, এবং মালিকানার শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন। চুক্তিতে যদি এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে উল্লেখ না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে তারা জমি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এজন্য, চুক্তিতে সব কিছু সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

২। স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন হতে হবেঃ চুক্তির প্রতিটি শর্ত এমনভাবে লিখতে হবে যাতে এর কোনো ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল বুঝাবুঝি না হয়। যেমন, যদি কোনো ভাড়া চুক্তি করা হয়, তবে চুক্তিতে ভাড়া পরিশোধের সময়, অগ্রিম ভাড়ার পরিমাণ, এবং অন্যান্য শর্তগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত। এতে করে কোনো পক্ষের মধ্যে বিভ্রান্তি বা দ্বন্দ্বের সুযোগ থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, রুবিনা নামে একজন ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। ভাড়ার পরিমাণ, অগ্রিম ভাড়া, এবং অন্যান্য শর্তাবলী চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকলে, রুবিনা এবং ফ্ল্যাট মালিকের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি বা দ্বন্দ্বের সুযোগ থাকবে না। এর ফলে, চুক্তিটি উভয় পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।

৩। বাস্তবিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবেঃ চুক্তি এমনভাবে লেখা উচিত যাতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে তা দ্রুত সমাধান করা যায়। যেমন, যদি কোনো সাপ্লাই চুক্তি করা হয়, তবে যদি কোনো কারণে সরবরাহ বিলম্বিত হয়, তখন চুক্তিতে সেই পরিস্থিতির জন্য সমাধানের প্রস্তাবনা থাকতে হবে, যেমন বিলম্বিত সরবরাহের জন্য ক্ষতিপূরণ। উদাহরণস্বরূপ, সোহেল নামে একজন ব্যবসায়ী ঢাকার বাইরে থেকে পণ্য সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি করলেন। কিন্তু, পণ্য সরবরাহে বিলম্ব হলে চুক্তিতে সেই পরিস্থিতির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এতে করে সোহেল তার ব্যবসায়িক ক্ষতির মোকাবিলা করতে পারবেন।

৪। যথেষ্ট নির্দিষ্ট হতে হবে যাতে পক্ষগুলো তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবেঃ চুক্তিটি যথেষ্ট বিস্তারিত হওয়া উচিত যাতে পক্ষগুলো তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে, তবে যদি পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়, তবে চুক্তি সেই পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হওয়া উচিত। যেমন, বাংলাদেশে কোনো নির্মাণ চুক্তি করলে, যদি নির্মাণকাজে বাধা সৃষ্টি হয়, তাহলে চুক্তিতে সেই অনুযায়ী কর্মপন্থা উল্লেখ থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, হাসান নামে একজন নির্মাণ ঠিকাদার ঢাকায় একটি ভবন নির্মাণের জন্য চুক্তি করলেন। যদি নির্মাণকাজে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়, তবে চুক্তিতে সেই অনুযায়ী নতুন কর্মপন্থা উল্লেখ থাকতে হবে, যাতে হাসান ও তার ক্লায়েন্টের মধ্যে কোনো সমস্যা না হয়।

৫। ক্লায়েন্টের লক্ষ্যগুলো উন্নীত করতে এবং তার ঝুঁকি কমাতে হবেঃ চুক্তি এমনভাবে লেখা উচিত যাতে ক্লায়েন্টের লক্ষ্যগুলো পূরণ হয় এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি কমে। যেমন, যদি বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক ঋণের চুক্তি করা হয়, তবে সেই চুক্তিতে ঋণদাতার পক্ষে শর্তাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত যাতে ঋণগ্রহীতার ঝুঁকি কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, সুমন নামে একজন ব্যবসায়ী একটি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে চাইলেন। সেই ঋণ চুক্তিতে যদি সুমনের পক্ষের শর্তাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে, তাহলে সুমনের ঋণগ্রহণের ঝুঁকি কমে যাবে এবং ব্যাংকের সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে।

৬। প্রত্যেক পক্ষকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট কিছু দেওয়া যাতে প্রত্যেকে চুক্তি করার পর সন্তুষ্ট থাকেঃ চুক্তি এমনভাবে লেখা উচিত যাতে দুই পক্ষই কিছু পায় এবং দুই পক্ষই সন্তুষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে কোনো যৌথ উদ্যোগের চুক্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে লাভের শেয়ার এবং দায়িত্বগুলো সুষমভাবে বন্টন করা উচিত যাতে কোনো পক্ষ বঞ্চিত না হয়। যেমন, করিম ও সজল নামে দুই ব্যবসায়ী একটি যৌথ উদ্যোগের চুক্তি করলেন। চুক্তিতে তাদের লাভের শেয়ার এবং দায়িত্বগুলো সুষমভাবে বন্টন করা হলে, তারা উভয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকবে।

৭। চুক্তিটি এমনভাবে লেখা উচিত যাতে এটি ফাইল ড্রয়ার থেকে বের করার প্রয়োজন না পড়েঃ চুক্তিটি এমনভাবে লিখতে হবে যাতে কোনো পক্ষের কাছ থেকে চুক্তির শর্তাবলীর ভুল ব্যাখ্যা বা অস্বচ্ছতার কারণে তা আদালতে গড়ানোর প্রয়োজন না হয়। যেমন, বাংলাদেশে একটি ভালোভাবে লেখা জমির বিক্রয় চুক্তি এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে তা নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমার সৃষ্টি না হয়। উদাহরণস্বরূপ, রেহানা নামে একজন মহিলা একটি জমি বিক্রয় চুক্তি করলেন। চুক্তিটি যদি স্পষ্টভাবে লেখা হয়, তবে ভবিষ্যতে তা নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমার সৃষ্টি হবে না, এবং রেহানা শান্তিতে থাকতে পারবেন।

৮। মামলা মোকদ্দমা প্রতিরোধ করতে হবেঃ চুক্তির একটি প্রধান লক্ষ্য হল যে তা থেকে কোনো বিরোধ উদ্ভব না হয় এবং তা আদালতে গড়ায় না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে যদি কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি করা হয়, তবে চুক্তিতে সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং সমস্যা মোকাবেলার উপায়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত যাতে দুই পক্ষই সেগুলো মেনে নিতে পারে এবং মামলার প্রয়োজন না হয়। যেমন, মেহেদী নামে একজন ব্যবসায়ী একটি নতুন ব্যবসা শুরু করতে চাইলেন এবং এজন্য একটি চুক্তি করলেন। চুক্তিতে যদি সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং সমস্যা মোকাবেলার উপায়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে, তবে মেহেদী এবং তার সহযোগীরা মামলার প্রয়োজন ছাড়াই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।

 

তাছাড়া যেসব চুক্তি রেজিস্ট্রেশন বা নোটারী পাবলিক করা বাধ্যতামূলক, সেগুলো রেজিস্ট্রেশন বা নোটারী পাবলিক করিয়ে নিবেন। আর যেগুলোতে এসব বাধ্যবাধকতা নেই, সেগুলো সম্পাদন করে নিজেদের মধ্যে সংরক্ষণ করলেই চলবে। এভাবেই একটি ভালোভাবে লেখা চুক্তি বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণ করতে সক্ষম হয় এবং পক্ষগুলোর মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে মৌখিক চুক্তির পরিবর্তে লিখিত চুক্তিভিত্তিক কার্যক্রম একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। চুক্তির সঠিক এবং স্পষ্ট লিপিবদ্ধকরণ নিশ্চিত করে দেশটির ব্যবসায়িক ও আইনি পরিবেশকে সুসংহত করা হয়।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

Navigating Legal Remedies When a Cheque Dishonor Case Is Dismissed

cheque dishonour

চেকের ডিসঅনার – কি, কেন, কিভাবে? 

তৃতীয় পক্ষের দেয়া চেক ডিসঅনার হলে কি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে?