চেক ডিজঅনার মামলা

চেকের মামলা খারিজ হলে কি করবেন?

ব্যবসায়িক আইন

শাহীন একজন ছোট ব্যবসায়ী। সম্প্রতি তার পরিচিত একজন ব্যবসায়ী বন্ধু, রফিক, তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শোধ করবে। রফিক একটি চেক দিয়েছিল শাহীনকে, কিন্তু যখন চেকটি ব্যাংকে জমা দেওয়া হলো, তখন তা অপর্যাপ্ত ব্যাল্যান্সের জন্য ডিসঅনার হয়ে যায়। শাহীন তখন রফিকের সাথে যোগাযোগ করলে রফিক বলে, ‘বন্ধু আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও, আমি তোমাকে সব টাকা একসাথে পরিশোধ করে দিবো’ । শাহীন চিন্তা করল কিছু দিন সময় দেওয়াই যায়। কেননা একটা চেক ডিজঅনারের মামলা করতে গেলে, প্রথমত মামলার ফাইলিং এবং আইনজীবীর একটা ফি রয়েছে, তার উপর মামলার ডেটে ডেটে শাহিনকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে, এতে যেমন তার সময় এবং অর্থ খরচ হবে, তেমনি নিজের ব্যবসার ক্ষতি হবে। তারচেয়ে বড় কথা শাহীন এবং রফিক যেহেতু একই এলাকায় ব্যবসা করে, সেহেতু মামলা করার কারনে তার সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে এবং একজন শত্রু বাড়ানো হবে। সবকিছু চিন্তা করে যখন শাহীন দেখল যে, এখনি মামলা করার দরকার নেই, তখন সে ঠিক করলো, আরো কিছুদিন সময় দিবে। 

তাছাড়া কোর্ট কাছারিতে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ চেকের মামলাতেই মামলা চলমান অবস্থায় দুই পক্ষ আপোষ করে ফেলে। কেননা, চেকের মামলায় যদি প্রতারণা বা মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া হয় অথবা মামলায় তেমন কোন ভুলত্রুটি না থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে ২/৩ বছরের মধ্যেই রায় হয়ে যায়। তখন চেকে উল্লেখিত টাকার অর্ধেক টাকা জমা না দিয়ে আসামী পক্ষ আপীলও করতে পারে না। এদিকে রায় হয়ে গেলে আসামীর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বের হয়ে যায়, যার ফলে চেকে বর্ণিত টাকার ৫০% জমা না দিয়ে আপীল করতে না পারলে আসামীকে জেলে বন্দী থাকতে হয়। তাই, আদালতে আমরা বেশীর ভাগ মামলায় দেখি যে, দুই পক্ষ আপোষ করে ফেলতেছে। কিন্তু, এই যে মামলা চললো এতদিন, বাদী পক্ষের যে সময় এবং অর্থ খরচ হল, এটা তো আর ফিরে আসবে না। তাই, অনেকেই মামলা করার ক্ষেত্রেও একটু সময় নিয়ে থাকে।

আমাদের গল্পের শাহিনও ঠিক একই ভাবে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু, এই অপেক্ষারও একটা সীমা আছে। একেক মামলার ক্ষেত্রে একেক রকম আর চেকের মামলার ক্ষেত্রে সেই সময়সীমা হচ্ছে, ৬ মাস। কেননা, চেকে যে তারিখ উল্লেখ থাকে বা যেটাকে আইনের ভাষায় বলা হয়, চেক ইস্যুর তারিখ, সেদিন থেকে ৬ মাস। এই ৬ মাসের মধ্যে যদি আপনি চেক ডিসঅনার না করান, তাহলে আপনি পরে চেক ডিসঅনারের মামলা করতে পারবেন না। 

কিছুদিন আগে আমি নিজে যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে আমাদের একটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন দেখলাম যে, বাদী চেকে উল্লেখিত তারিখের মাত্র ৪ দিন পরে মামলা দায়ের করার কারনে বিজ্ঞ আদালত সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। যদিও চেকের মামলা দায়ের করা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে, পরে সেটা বদলী হয়ে যুগ্ম দায়রা আদালতে আসে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কোন কারনে এই ভুলটি হয়ত চোখে পড়েনি, কিন্তু যুগ্ম আদালতের চোখে পড়া মাত্রই সেটি খারিজ করে দিয়েছেন। 

আমাদের গল্পের শাহিনেরও একই অবস্থা হয়েছে। সে তার বন্ধু রফিককে সময় দিতে দিতে কোন দিক দিয়ে যে ৬ মাস পার হয়ে গেছে, সেটা সে খেয়াল করেনি। সে যখন মামলা করতে গেলো তখন দেখা গেলো তার মামলা খারিজ করে দেওয়া হল। এখন তার করনীয় কি? 

শাহীনের মতো যারা চেকে উল্লেখিত সময়ের ৬ মাস পরে এসে চেকের মামলা করে পাওনা টাকা আদায় বা উদ্ধার করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য বলি, আপনারা ৬ মাস পরে এসে চেক ডিসঅনারের মামলা করে টাকা উদ্ধার করতে পারবেন না। কেননা, ৬ মাস পর ব্যাংক থেকে চেক ডিসঅনার করাতে পারলেও চেক ডিসঅনারের মামলা করতে পারবেন না, আর মামলা করতে পারলেও সেটা কোন না কোন পর্যায়ে এসে খারিজ হয়ে যাবে। 

কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে চেক ডিসঅনারের মামলা খারিজ হয়ে গেলে কি আপনার পাওনা টাকা ফিরে পাওয়ার অধিকার নষ্ট হয়ে যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। চেক ডিসঅনারের মামলা খারিজ হলে বা আপনি যখন বুঝতেছেন যে, মামলা করলে খারিজ হয়ে যাবে তখন আপনি সময় নষ্ট না করে যেতে হবে দেওয়ানী আদালতে। 

কেননা, Negotiable Instrument Act, 1881 মূলত একটি দেওয়ানী প্রকৃতির আইন। এই আইনের মাধ্যমে চেক, প্রমিসরি নোট বা বিল অব এক্সচেঞ্জের মতো আর্থিক দলিলের বিষয়গুলো নির্ধারণ ও পরিচালনা করা হয়। তবে, পরবর্তীতে ১৩৮ ধারা যোগ করার মাধ্যমে এই আইনে চেক ডিসঅনারের জন্য ফৌজদারি শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়। 

যদিও Negotiable Instrument Act, 1881 একটি দেওয়ানী আইন, কিন্তু আমরা সাধারণত এর মামলা করে থাকি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তথা ফৌজদারি আদালতে। এটি করা হয়েছিল মূলত দ্রুত নিষ্পত্তি এবং একটি শাস্তির বিধান প্রণয়নের জন্য। কিন্তু, আমরা চাইলে চেক ডিসঅনার হলে আসামী/বিবাদীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে মামলা করে পাওনা টাকা বা প্রাপ্য টাকা আদায় করতে পারি।  

লুৎফর রহমান বনাম রাষ্ট্র ও অন্য, 30 BLT (HCD) 497 মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, The Negotiable Instrument Act, 1881 একটি দেওয়ানী প্রকৃতির আইন ছিল এবং এখনও আছে। চেক গ্রহীতা ইচ্ছা করলে এখনও এ বিষয়টি দেওয়ানী আদালতে বিচারের জন্য দাখিল করে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারেন। এছাড়াও, ধারা ১৩৮-এ বর্ণিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে চেক গ্রহীতাকে দেওয়ানী আদালতেই টাকা আদায়ের নিমিত্তে মামলা দায়ের করতে হয়। শুধুমাত্র একটি ধারায় দন্ডের বিধান সংযুক্তির মাধ্যমে একটি দেওয়ানী আইন দন্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত হয় না। 

সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, The Negotiable Instrument Act, 1881 আইনটি এখনও সম্পূর্ণরূপে একটি দেওয়ানী প্রকৃতিরই আইন। তাই চেক ডিসঅনারের ক্ষেত্রে উভয় ধরণের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব—ফৌজদারি এবং দেওয়ানী। শাহীন বা শাহীনের মত যারা চেকের তামাদি মেয়াদের কারনে চেক ডিসঅনার মামলা করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বা তামাদির কারনে মামলা খারিজ হয়ে গেছে, তারা চাইলে দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। সময় হয়ত একটু বেশী লাগবে, কিন্তু আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে না, আপনি আপনার পাওনা টাকা উদ্ধার বা আদায় করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ্‌।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.