চেকের মামলায় কি কি লাগে এবং কত দিনের মধ্যে করতে হয়? 

ব্যবসায়িক আইন

কুমিল্লা জেলার একটি ছোট্ট গ্রামের বাসিন্দা শামিম। শিক্ষিত, সচেতন, এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই যুবক পরিবারের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। শামিমের শিক্ষাজীবন ছিলো সফলতায় পরিপূর্ণ। তিনি গ্রামের প্রথম ব্যক্তি যিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার প্রখর মেধা এবং অধ্যবসায়ের ফলে শিক্ষাজীবনে তিনি সবসময়ই প্রথম স্থান ধরে রেখেছেন। তবে, শামিমের ভাগ্যে উচ্চ শিক্ষার আলো থাকলেও জীবিকার ক্ষেত্রে তিনি অতটা ভাগ্যবান হননি। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশে একটি ভালো চাকরির অভাব শামিমকে হতাশায় নিমজ্জিত করে। কয়েকবারের চাকরির আবেদন ও ইন্টারভিউয়ের পরও যখন আশানুরূপ ফলাফল আসেনি, তখন তার সামনে একমাত্র বিকল্প হিসেবে উঠে আসে অন্য আট দশ জন অশিক্ষিত বেকারের ন্যায় প্রবাসে পাড়ি জমানো। 

মালয়েশিয়া যাওয়ার চিন্তা তার মনে আসে গ্রামের অন্য কিছু মানুষের কথা শুনে, যারা বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে পরিবারের জীবনে পরিবর্তন এনেছেন। শামিমের নিজের ও পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য সিদ্ধান্ত নেন মালয়েশিয়ায় গিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ভাগ্য বদলাবেন। 

তবে, বিদেশ গমনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ও খরচের কথা ভেবে শামিম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। বিদেশ যাওয়ার জন্য ভিসা প্রসেসিং, টিকিট এবং অন্যান্য খরচের জন্য প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের টাকা। এই সময়েই, তার সঙ্গে পরিচয় হয় হারুন নামে একজনের, যিনি বিদেশে লোক পাঠানোর কাজে সহায়তা করে থাকেন। হারুনের প্রস্তাবে বিশ্বাস করে শামিম তার কাছে ৫ লক্ষ টাকা দেন, যা তার পরিবারের জমি বিক্রি করা অর্থ এবং পরিবারের কাছ থেকে ধার করা টাকা।

হারুন প্রতিশ্রুতি দেন যে, চার মাসের মধ্যে ভিসার ব্যবস্থা করে শামিমকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। কথা অনুযায়ী, সিকিউরিটি বাবদ হারুন শামিমকে ৫ লক্ষ টাকার একটি চেক দেন। শর্ত ছিল, যদি চার মাসের মধ্যে হারুন ভিসার ব্যবস্থা করতে না পারেন, তবে শামিম সেই চেকটি নগদায়ন করে টাকা তুলে নিতে পারবেন। কিন্তু, এক বছর পার হওয়ার পরও হারুন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি। শামিম হতাশ হয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখন শামিম কীভাবে চেক ডিসঅনারের মামলা করবেন, তা ১৮৮১ সনের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা হলো।

১৮৮১ সনের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, চেক Dishonour হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে আসামীকে নোটিশ দিতে হবে। এরপর, নোটিশ প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। নোটিশ কিভাবে পাঠাতে হবে সেই বিষয়ে ইতিমধ্যে আমাদের ওয়েবসাইটে আরেকটি আর্টিকেল রয়েছে, সেটি দেখে আসতে পারেন। নোটিশ পাঠানোর পর যে নালিশি মামলা করতে হবে, সেই মামলায় কি থাকবে, সেটি নিম্নে তুলে ধরা হল উদাহরণসহঃ 

নালিশী দরখাস্তের মূল বিষয়সমূহ

চেক ডিসঅনারের মামলা করতে গেলে শামিমের পক্ষে আইনজীবীকে নিচের বিষয়গুলো নালিশী দরখাস্তে উল্লেখ করতে হবেঃ 

১। আদালতের নামঃ প্রথমে সেই আদালতের নাম উল্লেখ করতে হবে যেখানে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, “চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ঢাকা।”

২। বাদীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয়ঃ শামিমের সম্পূর্ণ নাম, ঠিকানা ও পরিচয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে, যাতে বাদীর পরিচয় নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা না থাকে।

৩। আসামীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয়ঃ হারুনের নাম, ঠিকানা ও পরিচয় সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। যদি হারুনের ঠিকানা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকে, তবে সম্ভাব্য সঠিক ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে।

৪। চেক লেনদেনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ শামিম ও হারুনের মধ্যে চুক্তির ধরন এবং চেক প্রদান সংক্রান্ত বিষয়টি সংক্ষেপে উল্লেখ করতে হবে।

৫। চেক প্রদানের তারিখ, হিসাব নম্বর, ব্যাংকের নাম, শাখার নাম, চেক নম্বর ও টাকার পরিমাণঃ যে চেকটি প্রদান করা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য যেমন: তারিখ, ব্যাংকের নাম, শাখার নাম, চেক নম্বর, এবং চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে।

৬। চেকটি ব্যাংকে জমা দেওয়ার তারিখ ও Dishonour হওয়ার কারণঃ চেকটি কখন ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছিল, এবং কখন ও কেন তা Dishonour হয়েছে, তা বর্ণনা করতে হবে।

৭। Dishonoured হওয়ার তারিখঃ চেকটি Dishonour হওয়ার নির্দিষ্ট তারিখটি উল্লেখ করতে হবে, যা আদালতে প্রমাণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

৮। নালিশের কারণঃ কেন শামিম মামলা দায়ের করছেন, এবং চেক Dishonour হওয়ার পর তিনি কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তা বর্ণনা করতে হবে।

৯। লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণের তারিখঃ শামিম কখন হারুনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন, সেই তারিখটি উল্লেখ করতে হবে।

১০। নোটিশ গ্রহণের বিবরণঃ হারুন নোটিশটি গ্রহণ করেছে কিনা বা তা ফেরত এসেছে কিনা, এই বিবরণ উল্লেখ করতে হবে।

১১। নোটিশের পরও টাকা আদায় না হওয়াঃ নোটিশের পরও হারুন টাকা পরিশোধ করেননি, এই বিবৃতি উল্লেখ করতে হবে।

১২। আসামীর জবাবঃ যদি হারুন নোটিশের জবাব দিয়ে থাকে, তবে সেই জবাবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে হবে।

১৩। ১৩৮ ধারায় অপরাধের বিবৃতিঃ আসামীর বিরুদ্ধে ১৩৮ ধারায় অপরাধ হয়েছে, এ মর্মে স্পষ্ট বিবৃতি দিতে হবে।

১৪। সাক্ষীদের নাম, ঠিকানা ও বাসস্থানঃ মামলা প্রমাণের জন্য যেসব সাক্ষী প্রয়োজন, তাদের নাম, ঠিকানা ও বাসস্থানের বিবরণ উল্লেখ করতে হবে।

১৫। প্রার্থীত প্রতিকারঃ শামিমের পক্ষে কোন ধরনের প্রতিকার চাওয়া হচ্ছে, তা উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “বাদী চেকে উল্লেখিত ৫ লক্ষ টাকা, সুদ ও অন্যান্য খরচ আদায়ের জন্য প্রার্থনা করছেন।”

শামিমের উচিত তার আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে দ্রুত মামলা দায়ের করা, যাতে তিনি তার পাওনা টাকা আইনি প্রক্রিয়ায় আদায় করতে পারেন। উক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, শামিম চেক ডিসঅনারের মামলায় সঠিকভাবে প্রতিকার পেতে সক্ষম হবেন। আপনি শামিমের মত ভুক্তভোগী হলে অবশ্যই একই প্রক্রিয়ায় মামলা করে পাওনা টাকা তুলে নিতে পারেন। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.