custody of child in bangladesh

তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে?

পারিবারিক আইন

সাবিহা এবং আয়মানের ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটলো পারস্পরিক বনিবনা না হওয়ার কারণে। দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহের ফলশ্রুতিতে একসময় তারা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের আট বছরের একটি কন্যা সন্তান এবং চার বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। পারস্পরিক সমঝোতার অভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও সন্তানদের ব্যাপারে দুইজনেরই অভিভাবকত্বের কোনো ঘাটতি ছিল না। সন্তানদের ভরণপোষণ, লালনপালন, টেক-কেয়ার সবকিছুতেই সাবিহা এবং আয়মান নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা তাদের সন্তানদের কথা চিন্তা করে তাদের বিবাহবিচ্ছেদটা এড়ানোরও বহু চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব এতটুকুই বেড়ে গিয়েছে যে, তারা কোন মতে আর একসাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করতে পারছে না।
উভয় পরিবারের সিদ্ধান্তে তারা কিছুদিন আলাদা থেকেও চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনমতেই তারা তাদের দাম্পত্য জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় সফল হতে পারেনি। তাদের দাম্পত্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তারা একে অন্যকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় কিছুটা কার্পণ্য করেছিল।
সন্তানদের অভিভাবকত্বের বেলায়ও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়, যার ফলে সাবিহা এবং আয়মানের পরিবার আর্থিক, শিক্ষা এবং স্ট্যাটাসগত দিক থেকে সমান হলেও কোন পরিবারই কোন পরিবারকে বা বিশেষ করে সাবিহা বা আয়মান কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয় সন্তানের অভিভাবকদের দিক থেকে। সাবিহা চায় তার উভয় সন্তানের অভিভাবকত্ব তার কাছে থাকুক। অন্যদিকে, আয়মানও চায় তার উভয় সন্তানের অভিভাবকত্ব তার কাছে থাকুক। কিন্তু তারা শুরু থেকেই একটা বিষয় নিয়ে সচেতন ছিল যে, পারিবারিক বিষয় নিয়ে আদালতের গিয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে বরং ঘরোয়া পরিবেশে সেটি সমাধান করবে।
কারণ, আইন যা বলে সেটা যদি মানুষ আইন মেনে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে ফেলে সেক্ষেত্রে আর আদালতে গিয়ে শ্রম, অর্থ, সময় অপচয় করার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া যেকোনো বিষয় নিয়ে আদালতে গেলে দীর্ঘ সময় পরে অর্থ খরচ করে রায় পেলেও প্রতিপক্ষের সাথে সম্পর্কটা আর কখনোই আগের মত ঠিকঠাক করা যায় না। কিন্তু আইন মেনে যদি উভয়পক্ষ ঘরোয়া পরিবেশে সমাধান করে, সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষই উভয়পক্ষের দিক থেকে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়, যার ফলে পারস্পরিক সম্পর্কটা ঠিক থাকে।
এজন্যই আইন কি বলে, মামলা করার ফলে শেষ পর্যন্ত আদালত কি ধরনের রায় দিতে পারে, সেটি যদি আমরা আগে থেকেই ধারণা রাখতে পারি, সেক্ষেত্রে বেশীরভাগ বিরোধ আমরা পারস্পরিক সমঝোতা করে সমাধান করতে পারি।
উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রেক্ষাপট তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। কিছুদিন আগেও আমাদের সমাজে বেশীরভাগ মানুষের মাঝে একটি ধারণা ছিল যে, যদি স্ত্রী তালাক দেয় সেক্ষেত্রে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর দিতে হবে না। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির আবির্ভাবের ফলে অনলাইনে লেখালেখি এবং ভিডিওর মাধ্যমে আইনি বিষয়গুলো সহজ বাংলা ভাষায় তুলে ধরার মাধ্যমে সবার মাঝে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে আজকের দিনে মোটামুটি সবাই জানে যে, তালাক যে পক্ষই দিক না কেন স্ত্রীর দেনমোহর স্ত্রী হক, স্ত্রীকে সেটি পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য।
অথচ, আজ থেকে এক যুগ আগেও গ্রাম্য, পৌরসভা এমনটি সিটিতেও সালিশে স্ত্রী পক্ষ থেকে যদি তালাক দেওয়া হতো সেক্ষেত্রে তাকে দেনমোহর দেওয়া হতো না; এ ধরনের বহু নজির রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ঘরোয়াভাবে যত বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স হচ্ছে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী তালাক দিলেও বরপক্ষ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। কেননা এখন সবাই জানে যে, স্ত্রী যদি আদালতে দেনমোহরের মামলা দায়ের করে সেক্ষেত্রে বরপক্ষ বাধ্যতামূলকভাবে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। এই আইনটুকু জানার কারণে বর্তমানে কেউ আর এই বিষয়গুলো নিয়ে নেহাতই বাধ্য না হলে আদালতে যায় না, বরং ঘরোয়াভাবে সমাধান করার জন্য উৎসাহিত হচ্ছে; যার ফলে বেঁচে যাচ্ছে সময়, অর্থ, শ্রম এবং আদালতের মূল্যবান সময়। তাই নিজ দায়িত্বে আইন জানলে, অন্যকে আইন জানালে সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়, তখন আর থানা, পুলিশ, আদালত, মামলা, হামলা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখে যেকোনো বিরোধ পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করা যায়।

এখন আমরা আসি আমাদের উপরের কাল্পনিক ঘটনায়, তালাকের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে সাবিহা বা আয়মান যদি আদালতে মামলা দায়ের করে, সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে যতটুকু সম্পর্ক ছিল, সেটি আরো তিক্ত হবে। যেই কথাগুলো শুধুমাত্র দুই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেই কথাগুলো গোটা দেশের জনগণ জানবে। একে অন্যের প্রতি কটূক্তি করবে, যে কথাগুলো সুস্থ মস্তিষ্কে বলার কথা নয় সেগুলোও হয়তো ক্ষোভে বা উস্কানিতে বলে ফেলবে এবং আদালতে মাসকে মাস, বছরকে বছর যখন হাজিরা দিতে যাওয়া-আসা করবে, তখন তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও অস্বাস্থ্যকর হবে।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সাবিহা এবং আয়মান বা যেকোনো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন সেটা শুধুমাত্র তাদের দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ বা তালাক হয়। তাদের সাথে তাদের সন্তানের কিন্তু কখনোই তালাক হয় না। কিন্তু যদি মামলার মাধ্যমে বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে নিয়মিত আদালতে দৌড়াদৌড়ি করে তখন সন্তানের বাবা বা বাবার পরিবার সবসময় সন্তানদের কাছে তাদের মা এবং মায়ের পরিবার নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করবে, একইভাবে মা এবং মায়ের পরিবার তাদের সন্তানদের কাছে বাবা এবং বাবার পরিবার সম্বন্ধে আজেবাজে মন্তব্য করবে; যেগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সন্তানদের উপর। তাই এই ধরনের পারিবারিক বিষয়গুলো সবচেয়ে ভালো হচ্ছে পারিবারিকভাবে ঘরোয়া পরিবেশে বসে সমাধান করা আর ঘরোয়া পরিবেশে সমাধান করতে হলে অবশ্যই আপনাকে আইন জানতে হবে। চলুন আজকে আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি, মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তানদের অভিভাবকত্বে মায়ের অধিকার কতটুকু এবং বাবার অধিকার কতটুকু?
এক লাইনে যদি বলা যায় সেক্ষেত্রে, বিবাহ বিচ্ছেদের পরে ছেলে সন্তান সাত বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবেন এবং মেয়ে সন্তান বয়সন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। ছেলে সন্তান যখন সাত বছর পার করে ফেলবে এবং মেয়ে সন্তান যখন বয়সন্ধিকাল পার করবে তখন তারা তাদের বাবার কাছে চলে যাবে। কিন্তু সন্তানদের সর্বদাই ভরণপোষণের দায়িত্ব থাকবে বাবার উপর, কেননা বাবাই হচ্ছে সন্তানদের স্বাভাবিক অভিভাবক, মা ঐ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জিম্মাদারের ভূমিকা পালন করবেন (যদিও আদালত চাইলে মাকেও অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন)। উভয় পরিবারের পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করলে উভয় পরিবারের সম্মতিতে সন্তানদের অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করতে পারেন এবং একজনের কাছে থাকার সময় অন্যজন কিভাবে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারে সে বিষয়েও সমঝোতা করতে পারেন।

ছেলে সন্তানের বয়স সাত বছর হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়সন্ধিকাল পর্যন্ত যেহেতু মায়ের কাছে থাকবে, ওই সময়টিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা তার জিম্মাদারের অধিকার হারাতে পারেন। বিভিন্ন কেস রেফারেন্সের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, মা যদি অসৎ জীবন যাপন করে থাকেন কিংবা মা যদি পুনরায় বিবাহ করে থাকেন (এটির ব্যতিক্রমও আছে) কিংবা সন্তানের প্রতি অবহেলা করে থাকেন সেক্ষেত্রে আদালতে বাবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মা তার জিম্মাদারের অধিকার হারাতে পারেন। সর্বোপরি, সন্তানদের জন্য যেখানে থাকা উপযোগী, আদালত সেখানেই তাদেরকে থাকার আদেশ দিবেন।
ভবিষ্যতে আরও একটি পর্বে আমরা এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো, যেখানে বাবার অবর্তমানে কিংবা মায়ের অবর্তমানে কে অভিভাবক হতে পারে বা কাদের জিম্মায় সন্তান থাকতে পারে এবং সেগুলো কিভাবে আবেদন করতে হবে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.