তালাক নিয়ে যত জানা-অজানা

তালাক

তালাক হচ্ছে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দুইজন মানুষ একে অন্যকে বিবাহ করে থাকে, যার পরিণতি কখনোই তালাকের মাধ্যমে নিঃশেষ হোক কেউই আশা করে না। তবে ঘটনাচক্রে বা সময়ের প্রয়োজনে বা কোন একজনের গুরুতর অন্যায়ের কারণে বা অন্য নানাবিধ কারণেই তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের মত করুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তালাকের নেতিবাচক দিক নিয়ে এবং তালাক ঠেকানোর জন্য একাধিক আর্টিকেল আমরা ইতিমধ্যে আমাদের ওয়েবসাইটে লিখেছি। তবে, আজ প্রথমবারের মত আমরা তালাক নিয়ে করা (FAQ) বারংবার প্রশ্ন গুলোর মধ্যে কিছু প্রশ্ন নিয়ে নিম্নে একে একে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

তালাক নোটিশ পাঠানোর নিয়ম
তালাক নোটিশ পাঠানোর নিয়ম হচ্ছে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী, স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক নোটিশ দিতে হবে স্ত্রীর ঠিকানা বরাবর এবং সালিশি পরিষদ তথা ইউনিয়নের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে মেয়রের কাছেও একটি নোটিশ পাঠাতে হবে। তবে কেউ যদি এই তালাক নোটিশ না পাঠায় তাহলে এক বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

সালিশি পরিষদ ৩ মাসে ৩ টি নোটিশ পাঠিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করবে যাতে তাদের তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদটি ঠেকানো যায়। কিন্তু, যখন ৩ মাসে ৩ টি নোটিশ পাঠানোর পরও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা না হয় তখন তাদের মধ্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের সালিশি পরিষদ এই সমঝোতা করার বেলায় বেশ উদাসীন। অনেক সময় দেখা যায় যে, ৩ মাসে ৩ টি নোটিশ পাঠিয়ে উভয় পক্ষকে ডেকে যে সমঝোতার চেষ্টা করার কথা, সেই নোটিশ পর্যন্ত পাঠানো হয় না। তবে ভাগ্য ভালো যে, নোটিশ পাঠালে সেটি প্রত্যাখ্যান না করে গ্রহণ করে অন্তত।

স্ত্রী কর্তৃক তালাকের নোটিশ পাঠানোর নিয়ম
স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিতে চায়, তার ক্ষেত্রেও উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী তালাক নোটিশ পাঠাতে হবে।

তালাক নোটিশ লেখার নিয়ম
তালাক নোটিশ লেখার নিয়ম নিয়ে আইনে স্পষ্ট বা নির্দিষ্ট কোন ফরম্যাট দেওয়া নাই। আমাদের দেশে তালাক দেওয়ার জন্য কেউ মনে করে কাজীর মাধ্যমে দেওয়া উচিত, কেউ মনে করে উকিল বা আইনজীবীর মাধ্যমে দেওয়া উচিত। এমনকি এটা নিয়ে বেশ তর্কবিতর্কও রয়েছে। অথচ, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর কোথাও বলা নাই তালাক নোটিশ কার মাধ্যমে লেখাতে হবে। তাই, তালাক নোটিশ স্বামী বা স্ত্রী ইচ্ছে করলে নিজে লিখেও পাঠাতে পারবেন। আজকের পর্বে সম্ভব হচ্ছে না, তবে পরবর্তী পর্বে আমরা চেষ্টা করবো তালাক নোটিশ লেখার নিয়ম এবং তালাক নোটিশের একটি নমুনা নিয়ে। যাতে নিজে নিজে কিভাবে নিজের তালাক নোটিশ লিখা যায়, সে বিষয়ে অতীব সহজ উপায়ে নমুনাপত্র তৈরির মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করবো।

তালাকের নোটিশ গ্রহণ না করলে
উট পাখিকে যখন কেউ তাড়া করে, তখন উট পাখি দৌড়ে গিয়ে বালির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেয় যাতে কেউ দেখতে না পায়। আদৌতে উট পাখি বালির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিলে উট পাখি কাউকে দেখতে পায় না ঠিকই, কিন্তু সবাই উট পাখিকে দেখতে পায়। তেমনি ভাবে, তালাক নোটিশ যখন কারো বাসার ঠিকানায় আসে তখন সবাই নোটিশ গ্রহণ না করে উট পাখি সাজার চেষ্টা করে, যা প্রকৃতপক্ষে তার কোন উপকারেই আসে না। কেননা, তালাক নোটিশ আপনি গ্রহণ করুন বা না করুন, তালাক নোটিশের কপি আপনার কাছে পাঠানোই নোটিশ দাতার জন্য দায়িত্ব হিসেবে যথেষ্ট। বাকিটা সালিশি পরিষদ থেকেই প্রক্রিয়াজাত করা হবে। তাই এক কথা বলা যায় যে, তালাক নোটিশ গ্রহণ না করলে বা না নিলেও তালাক হয়ে যাবে যদি না পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা না হয়।

তালাকের কয়টি নোটিশ দিতে হয়
তালাকের জন্য একটি নোটিশ স্বামী বা স্ত্রীর ঠিকানা বরাবর পাঠাতে হবে আর একটি কপি সালিশি পরিষদে পাঠাতে হবে। সালিশি পরিষদ ৩ মাসে ৩ টি নোটিশ পাঠাবে সমঝোতার জন্য। কিন্তু, যিনি তালাক দিচ্ছেন তিনি পাঠাবেন একবারেই স্বামী বা স্ত্রী বরাবর একটি এবং সালিশি পরিষদ বরাবর একটি।

তালাকের নোটিশ কিভাবে পাঠাতে হয়
তালাক নোটিশ কিভাবে পাঠাবেন তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোন একটি ফরম্যাট নেই। কেউ হাতে হাতে দেয়, কেউ ডাকযোগে দেয়, কেউ কুরিয়ারে দেয়, সামনের দিকে হয়ত অনলাইনেরও তালাক নোটিশ পাঠাবে। তবে, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে তালাক নোটিশ পাঠানো। কারণ এতে নোটিশ পাঠানোর যেমন প্রমাণ থাকে তেমনি নোটিশ গ্রহণ না করলে সেটি ফেরত আসে। নোটিশ কেন ফেরত আসলো সেটিও উল্লেখ থাকে, যার ফলে প্রয়োজনে প্রমাণ হিসেবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যায়।

তালাক নোটিশ পাঠানোর পর পুনরায় সংসার করার নিয়ম
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭ ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী, তালাক কার্যকর হয় তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পর। তাই তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যে যদি সালিশি পরিষদ বা ঘরোয়া পরিষদে বা নিজেরা যেকোনো উপায়ে যদি সমঝোতা করতে পারে তাহলে কোন প্রকার বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই সংসার করতে পারবে। তবে, কোন পক্ষ চালাকি করতে পারে বলে সন্দেহ থাকলে সালিশি পরিষদে গিয়ে সমঝোতার বিষয়টি লিখিত আকারে জানিয়ে রাখতে পারেন যাতে ৯০ পর এসে সমঝোতার কথা অস্বীকার করে তালাক কার্যকর করানোর নাটক করতে না পারে। আবার, ৯০ দিন পর যদি সমঝোতা হয়, তখন নতুন নিকানামা রেজিস্ট্রি করে নতুন করে বিবাহ করতে হবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন: তালাকের পর একই স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে

তালাকের পর পুনরায় বিয়ে করার নিয়ম
তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর কোন ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক বলবত থাকে না বলে স্বামী স্ত্রী তখন ইচ্ছে করলেই নতুন কাউকে বিবাহ করতে পারে। তালাক কার্যকর হয়, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭ ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী, তালাক নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পর। এরপর বাহিরে বিয়ে করার ক্ষেত্রে আইনত কোন বাঁধা নেই। তবে, তালাক নোটিশ পাঠানোর পর স্ত্রী যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে সন্তান জন্ম দেওয়া এবং নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যে যেটি পরে হবে, সেদিন তালাক কার্যকর হবে। গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক বা গর্ভবতী স্ত্রী কর্তৃক তালাক নিয়ে আরেকটি আর্টিকেল লিখবে হবে, বিষয়টি স্পষ্টত করার জন্য; ইনশাআল্লাহ্‌ পরবর্তী পর্ব গুলোতে চেষ্টা করবো। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ডিভোর্স ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে: আইন কি বলছে?

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর আদ্যোপান্ত 

পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ এবং শাস্তির বিধান