পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ এবং শাস্তির বিধান 

পারিবারিক আইন

পারিবারিক সহিংসতা বুঝানোর জন্য চলুন আমরা একটা পরিবারের গল্প বানাই। গল্পটি শুরু হয় বাংলাদেশের একটি গ্রামের সাধারণ পরিবার নিয়ে, যেখানে থাকে রেহানা নামে এক গৃহবধূ। রেহানার বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে, তার স্বামী রাশেদ একটি ছোট ব্যবসা করে। বিয়ের পর থেকেই রেহানা তার শাশুড়ি ও ননদের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করছে। শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও, সময়ের সাথে সাথে রেহানার জীবনে ধীরে ধীরে শুরু হয় পারিবারিক সহিংসতা।

রেহানার শাশুড়ি প্রায়ই তাকে নানা কাজের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করত। সে রেহানাকে রান্না ও ঘরের সমস্ত কাজ করতে বাধ্য করত এবং কোনো ভুল হলেই অপমানজনক কথাবার্তা বলত। রেহানার ননদও প্রায়ই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত এবং তার চলাফেরার স্বাধীনতায় বাধা দিত। এমনকি রেহানার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশ করার সুযোগও দেওয়া হত না। আর্থিকভাবেও রেহানার কোন অধিকার ছিল না। তার স্বামীও তাকে কোনো ব্যক্তিগত খরচ দেয় না।  এমন এক পরিস্থিতিতে রেহানা বুঝতে পারছিল না কীভাবে এই নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে। একদিন, নির্যাতন চরমে পৌঁছালে রেহানা সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আইনের সাহায্য নিবে।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ৩ ধারার আলোকে পারিবারিক সহিংসতার অপরাধগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। চলুন, রেহানা এবং তার পরিবারের মাধ্যমে আমরা পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ সমূহ সম্বন্ধে ধারণা নেই।

পারিবারিক সহিংসতাঃ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে থাকা কোনও ব্যক্তি অন্য কোনও নারী বা শিশুর উপর শারীরিক, মানসিক, যৌন বা আর্থিক ক্ষতি করলে, সেটিকে পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে গণ্য করা হবে। নিচের প্রতিটি পয়েন্টের ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো হলো।

 

ক) শারীরিক নির্যাতনঃ শারীরিক নির্যাতন বলতে এমন কোনও আচরণ বোঝায়, যা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির শরীর বা জীবনের ক্ষতি হয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণঃ রেহানার শাশুড়ি প্রায়ই তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করত। যেমন, কোনো কাজ ঠিকমতো না করলে তাকে হাত দিয়ে মেরে ফেলা, জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা। এর ফলে রেহানা আঘাত প্রাপ্ত হয়, যা শারীরিক নির্যাতন।  

খ) মানসিক নির্যাতনঃ মানসিক নির্যাতন বলতে বোঝায়, এমন কিছু কথাবার্তা বা আচরণ, যা কাউকে মানসিকভাবে আঘাত করে বা দুর্বল করে তোলে। 

  • (অ) মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞাঃ রেহানার শাশুড়ি প্রায়ই তাকে অপমান করত, যেমন “তুমি কোন কাজ করতে পারো না,” “তুমি অলক্ষ্মী,” ইত্যাদি বলে তাকে মানসিকভাবে আঘাত করত।
  • (আ) হয়রানিঃ রেহানার ননদ প্রায়ই তার কাজে বাধা সৃষ্টি করত, ইচ্ছে করে কাজের মধ্যে ভুল ধরত এবং তাকে নানা ভাবে হয়রানি করত।
  • (ই) ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপঃ রেহানার শাশুড়ি ও ননদ তার চলাফেরা ও আত্মীয় স্বজনসহ বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগের স্বাধীনতায় বাধা দিত। তাকে কোথাও যেতে দেওয়া হত না, এমনকি পরিবারের বাইরে কারও সাথে কথা বলতেও নিষেধ করত। রেহানা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারত না।

গ) যৌন নির্যাতনঃ যৌন নির্যাতন বলতে বোঝায়, যে কোনও যৌন আচরণ যা ব্যক্তির সম্মান ও সুনাম ক্ষুণ্ণ করে। যেমন ধরুন, রেহানার কোন দেবর বা পুরুষ সদস্য রেহানাকে যৌন নির্যাতন করলো বা যৌন আচরণ করলো।  

ঘ) আর্থিক ক্ষতিঃ আর্থিক ক্ষতি বলতে বোঝানো হয়, যখন কাউকে তার আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় অথবা তার প্রাপ্ত সম্পদ বা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।

  • (অ) আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাঃ রেহানার শাশুড়ি ও স্বামী তাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ঠিকমতো দিত না। তার ব্যক্তিগত খরচের জন্য কোনো টাকা দেওয়া হত না। তাকে স্বামীর আয় থেকে বঞ্চিত করা হত। 
  • (আ) নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র না দেওয়াঃ রেহানার শাশুড়ি প্রায়ই তাকে খাবার ও নিত্যব্যবহার্য জিনিস সরবরাহে বাধা দিত। অনেক সময় রেহানাকে অনাহারে থাকতে বাধ্য করত। মোট কথায় ন্যায্য ভরণপোষণ থেকে রেহানা বঞ্চিত হচ্ছে।
  • (ই) উপহারে বঞ্চিত করাঃ রেহানার বিয়েতে পাওয়া উপহার বা স্ত্রীধন শাশুড়ি ও ননদ তাদের দখলে রেখে দিয়েছিল এবং রেহানাকে এসব ব্যবহার করতে দিত না।
  • (ঈ) সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করাঃ রেহানার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তির উপরেও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, তাকে সেই সম্পত্তি বিক্রি করে শ্বশুরবাড়িতে টাকা জমা দিতে বাধ্য করতে চেয়েছিল।
  • (এ) পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাঃ রেহানাকে বাড়ির কোনো সম্পদ ব্যবহার করতে দেওয়া হত না। এমনকি, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো সহজে চলাফেরার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।

এখানে রেহানা চরিত্রটি কাল্পনিক, তবে ধারা ৩ এর প্রতিটি পয়েন্ট অনুযায়ী, রেহানার মতো কেউ যদি শারীরিক বা মানসিক বা যৌন বা আর্থিক নির্যাতনের শিকার হয়, তবে এই আইনের অধীন তিনি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। অভিযোগ প্রমানিত হলে কি কি শাস্তি হতে পারে, তা নিম্নে দেখানো হল।  

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ৩০ ধারা অনুযায়ী, উপরের কাল্পনিক রেহানার শাশুড়ি, ননদ এবং স্বামী সকলেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ায় অভিযুক্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা অপরাধ প্রমাণিত হলে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি পেতে পারে। যদি তারা পুনরায় এই অপরাধ করে, তাহলে ২ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।

তবে, কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে তার জন্যও রয়েছে শাস্তির বিধান। ধরুন, রেহানা যদি মিথ্যা অভিযোগ করে এবং প্রমাণিত হয় যে তিনি স্বার্থান্বেষণে এই অভিযোগ করেছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩২ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা অভিযোগ করার শাস্তি হিসেবে রেহানা ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

পরিশেষে, গল্পটি রেহানার মত ভুক্তভোগীদের জীবনের করুণ বাস্তবতা ও আইনের শক্তিকে কেন্দ্র করে রচিত। পারিবারিক সহিংসতা থেকে রেহানার মতো ভুক্তভোগীরা মুক্তি পেতে পারে কেবল আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই নিজে আইন জানুন এবং অন্যকে আইন জানতে আমাদের আর্টিকেল গুলো শেয়ার করুন, ধন্যবাদ।  

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.