পালায় বিয়ে

পালিয়ে বিয়ে এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থা

পারিবারিক আইন

পালিয়ে বিয়ে করতে কি কি লাগে?
৯ টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে?
সাধারণ বিয়ে করতে যা যা লাগে, পালিয়ে বিয়ে করতেও তাই তাই লাগে। একজন পাত্র, একজন পাত্রী, সাক্ষী, দেনমোহর, কাজী ইত্যাদি। কেউ কেউ মজা করে বলে যে, পালিয়ে বিয়ে করতে নাকি একটু বাড়তি সাহস লাগে।
বাংলাদেশে বিয়ে করার জন্য আপনার যোগ্যতা হচ্ছে, আপনি ছেলে হলে আপনার ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে আর আপনি মেয়ে হলে আপনাকে ১৮ বছর বয়স্ক হতে হবে। যদি কোন ছেলে বা বিয়ের পাত্র ২১ বছর এবং মেয়ে বা বিয়ের পাত্রী ১৮ বছর প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আইনত ভাবে তাদের বিয়েতে কোন বাঁধা নেই। বাঁধা দিলে দিতে পারে, বাবা মা বা অভিভাবক।

বিয়ের বয়স হওয়া সত্ত্বেও বাবা মা বা অভিভাবক যদি নিজ ইচ্ছা বা পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করতে বা দিতে না চায়, তাহলে করণীয় কি?
করণীয় জানার আগে জানি চলুন, কেন ছেলে মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে এবং কেনই বা তারা পালিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

ছেলে মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে কেন করে?
বিয়ের বয়স হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মা কিংবা অভিভাবক নিজের পছন্দ অনুযায়ী যদি বিয়ে দিতে বা করাতে সম্মত না হয়, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দেখা যায় যে, ছেলে মেয়েরা গোপনে কিংবা পালিয়ে বিয়ে করে থাকে। একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে যখন পরস্পরের মধ্যে মনের আদান প্রদান করে ফেলে, তখন তাদের মধ্যে বিয়ে করে সংসার করার যে সুপ্ত ইচ্ছা তৈরি হয়, সেটি অনেক সময় পরিবার থেকে মেনে নেওয়া হয় না।
যার ফলে ছেলে মেয়ে সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে অন্যত্র ঘর সংসার করতে শুরু করে। বেশীরভাগেরই পরিণতি শুভকর হয় না, তবে যে বয়সের ছেলে মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে, তাদের ঐ সময়টাতে এতো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না যে, তারা কি করছে বা জীবন আদৌতেই নাটক সিনেমার মত যে নয়, সেটি তারা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায়ও না।
এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েরা। কারণ, একটা ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে আবার বাড়ি ফিরে আসলে তার মানসম্মান তেমন ক্ষয় হয় না, কিন্তু একটি মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলে ঐ বাড়ির দরজা তার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ঐ মেয়েকে বাবা মা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে। তবে, ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়।

ছেলে মেয়েদের পালিয়ে বিয়ের কারণ কি?
কোন ছেলে মেয়েই স্বাভাবিক ভাবে চায় না পালিয়ে বিয়ে করতে। সবাই চায়, বাবা মায়ের দোয়া নিয়ে বিয়ে করতে। কিন্তু, বিপত্তি হয় যখন বাবা মায়ের পছন্দের সাথে ছেলে মেয়ের পছন্দের মিল হয় না। কেন মিল হয় না, আসুন সেটা দেখি:
প্রথমত, যে বয়সে পালিয়ে বিয়ের করার জন্য ছেলে মেয়েদের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, সে বয়সে হয়তো দেখা গেছে তাদের একজনের বা উভয়েরই এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। তখন বিয়ে করলে পড়াশোনা শেষ করতে পারবে কিনা বা ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে পারবে কিনা এই দুশ্চিন্তায় বাবা মা সন্তানদের বিয়েতে রাজি হয় না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে যেহেতু ছেলেকে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়, সেহেতু ছেলে যদি বয়সের কারণে বা যোগ্যতার অভাবে কোনো কর্ম ক্ষেত্রে না পৌঁছে থাকে, তাহলে বাবা মা বা অভিভাবকরা তাদেরকে বিয়ের জন্য তখনো উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেন না।
তৃতীয়ত, বেশির ভাগ বাংলা সিনেমার থিম, স্ট্যাটাসগত সমস্যা। ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্ট্যাটাস গত মিল না থাকলে তখন কোন ভাবেই ছেলে মেয়ের পছন্দের পাত্র পাত্রীর সাথে বিয়েতে বাবা মায়ের সম্মতি থাকে না।
চতুর্থত, বাবা মায়ের নিজেদের পছন্দ করা পাত্র পাত্রী থাকে, যার ফলে ছেলে মেয়েদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে দিতে আগ্রহী হয় না।
এর বাহিরেও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিকসহ আরও অনেক ধরনের কারণেই পরিবার থেকে ছেলে মেয়েদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে দেওয়া হয় না।

 

পালিয়ে বিয়ে ঠেকাতে করণীয়
পালিয়ে বিয়ের একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজ থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিবারে। একটি পরিবারের মধ্যে একটি ছেলে বা মেয়ে যখন পালিয়ে যায়, তখন এই বিষয়টি নিয়ে পরিবারের মধ্যে যেসব আলোচনা সমালোচনা হয়, এতে পারিবারের বাকি সদস্যদের মধ্য থেকে চক্ষু লজ্জা চলে যায়। অভিভাবকের অনেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সামাজিকতার কথা চিন্তা করে। অনেককেই স্ট্রোকে পর্যন্ত আক্রান্ত হয় পরিবারের কারো এমন কর্মকাণ্ডের কারণে। তাছাড়া, বেশির ভাগ মেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় পালিয়ে বিয়ে করার কারণে, যার ফলে মেয়ের পরিবার চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে। তাই, এই পালিয়ে বিয়ে করার বিষ্যটিকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি এটিকে মূল থেকে সমাধান করা উচিত।
ছেলে মেয়েরা কম বয়সে আবেগে পড়ে অনেকে ধরনের ভুল করে থাকে, সেখানে বাবা-মায়েরা অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন; যার ফলে বাবা মা বা অভিভাবকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, কার সাথে বিয়ে দিলে বাকি জীবন অতিবাহিত করা তার ছেলে বা মেয়ের জন্য ভালো হবে, সহজতর হবে। এখানে কোনভাবেই কোন ছেলে মেয়ের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগকে খাটো করা হচ্ছে না, বরং কম বয়সে ভুল করার সম্ভাবনা অনেক বেশি, সেই বিষয়টিতে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কম বয়সে আবেগে পড়ে কাউকে ভালোবেসে বা বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করতে গিয়ে পরে নিজেই বিপদে পড়েছে। কারণ আবেগ এবং জেদ যখন একসাথে কাজ করে তখন আমাদের স্বাভাবিক হিতাহিত জ্ঞান কাজ করে না।

আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, কাছের মানুষকে দূরের মনে করি, দূরের মানুষকে কাছের মনে করে থাকি। আপনকে পর এবং পরকে আপন ভাবতে শুরু করি; যার ফলে আমাদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

তাই ছেলেমেয়ের করণীয় হচ্ছে, বাবা মাকে নিজের পছন্দের ছেলে বা মেয়ে সম্বন্ধে সঠিক ধারনা দেওয়া। বাবা মায়ের কাছ থেকেও এটা জানার চেষ্টা করা কেন ওনারা আমার পছন্দের ছেলে বা মেয়েকে পছন্দ করছে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা আমাদের সমাজে হয় না বলেই পালিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে। তাই আলোচনার মাধ্যমেই ভবিষ্যতের অপ্রীতিকর পরিস্থিতিকে গলা চাপা দিতে হবে।

পালিয়ে বিয়ে করলে বাবা মা যেমন সামাজিক ভাবে, মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি পছন্দের মানুষ, ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে না পারার জন্য আপনার এই ছোট্ট ছেলে বা মেয়েটিও ভেতরে ভেতরে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। উঠতি বয়সেই তাদের মনের মধ্যে একটি ক্ষত তৈরি হয়ে যাচ্ছে, এতে তাদের মাঝে বাবা মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধার জন্ম দিবে এবং যা তারা আজীবন বয়ে বেড়াবে; এই বিষয়টিও বাবা মাকে মাথায় রাখা উচিত।

শুধুমাত্র আপনার পছন্দের সাথে আপনার সন্তানের পছন্দের মিল হয়নি বলে আপনি তাদের বিয়েতে অসম্মতি না জানিয়ে বরং বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন, একটু সময় নিন, কাউন্সিলিং করুন। ক্যারিয়ার নিয়ে অভিভাবকের পছন্দের সাথে সন্তানের পছন্দের মিল না হলে আমরা কত কাউন্সিলিং করি; তাহলে যার সাথে পুরো জীবন কাটাবে, যার সাথে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের জন্ম দিবে, সেটি নিয়ে কেন কাউন্সিলিং না করে জোরাজুরি হবে?

সুখ শান্তি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত, সেটির জন্য আমরা কেবল চেষ্টা করতে পারি, দেওয়ার মালিক আল্লাহ্‌। তাই, কোন কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি ভালো নয়, এটি মাথায় রেখেই সন্তান এবং পিতামাতাকে পালিয়ে বিয়ের পরিবর্তে আমাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ঘরোয়া পরিবেশে সকলের সম্মতির বিয়েতে আগ্রহী হওয়া উচিত।
দাওয়াত দিবেন?- তাহলে চলে আসবোনে!

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.