মোবাইলে বিয়ে অতঃপর সহবাসের পূর্বেই তালাক হলে; দেনমোহর কত?

মোবাইলে বিয়ে ও ডিভোর্স

রুবেল জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ড্রাইভিং করছে। মধ্যপ্রাচ্য বলতে এখানে আপনি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া, ওমান, আবুধাবির মতো যে কোন একটি দেশ ধরে নিতে পারেন। সারাদিন কাজকর্ম করে বাসায় আসার পরে যখন বিশ্রাম নেন বা ছুটির দিনগুলোতে যখন অলস সময় কাটান, তখন বিভিন্ন সময় মোবাইলে দেশের বিভিন্ন খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করার একপর্যায়ে যেকোনোভাবেই হোক অথবা ফেসবুক বা ইমোর মাধ্যমে এক বাংলাদেশী মেয়ে সুমির সাথে পরিচয় হয় এবং তাদের মধ্যে নিয়মিত কথাবার্তা শুরু হয়।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে প্রথমে ভাবের আদান-প্রদান হতে থাকে, পরে মনের আদান-প্রদান শুরু হয় যা এক পর্যায়ে প্রেম ভালোবাসায় রূপ নেয়। এভাবে মাস খানিক চলতে চলতে এক সময় রুবেল এবং সুমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে বলে মনস্থির করে।

রুবেল তার বাড়িতে জানায় এবং তারা তাতে সম্মতি দেয় এবং সুমির বাড়িতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রস্তাব পাঠায়। ছোট খাট কিছু বিষয়ে সামান্য চাহিদা বা আপত্তি নিয়ে কথা কাটাকাটি হলেও দিন শেষ দুই পরিবার রুবেল এবং সুমির বিবাহে সম্মতি প্রদান করেন। প্রথমে কথা হয় যে, রুবেল দেশে ফিরলে বিবাহ করানো হবে, কিন্তু আকামার জটিলতার কারণে দেশে আসাটা কিছুটা সময় সাপেক্ষ বলে পরবর্তীতে মুরুব্বীরা স্থির করলো এখন মোবাইলে বিবাহ পড়ানো হয়ে থাকুক, এতে ছেলে মেয়ের বর্তমান যোগাযোগটি আর দৃষ্টিকটু হবে না; ধর্ম এবং আইনের দৃষ্টিতেও বৈধতা থাকবে।

যে কথা সেই কাজ, ৫ লক্ষ টাকা কাবিন নির্ধারণ করে মোবাইলে বিবাহের ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয় এবং রুবেল ঐ ৫ লক্ষের মধ্যে মাত্র ১ লক্ষ টাকা উশুল দেখিয়ে বাকি অংশ বকেয়া রেখে মোবাইলের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করে। মোবাইলে বিবাহ সাধারণত আমরা জানি যে, ইসলামিক ধর্মীয় রীতি অনুসারে হুজুরের মাধ্যমে উভয় পক্ষের অভিভাবকের উপস্থিতিতে খুৎবা পড়ে পাত্রপাত্রীর সম্মতি দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। আর কাবিননামা বা নিকানামার যে বিষয়টি রয়েছে, সেটিতে মেয়ের স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হলেও সাধারণত ছেলে দেশে আসলে ছেলের স্বাক্ষর নেওয়া হয়ে থাকে। আবার, কোথাও কোথাও ছেলের অভিভাবককে পাওয়ার দেওয়া হলে ছেলের অভিভাবক কাবিননামার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।

যাই হোক মূল কথা হচ্ছে, বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে এবং স্বামী স্ত্রী এখন আইনত বৈধ। তবে দূরত্বের কারণে এখনো তাদের মাঝে পূর্বের ন্যায় প্রেমালাপ চলছেই এবং স্ত্রীর আবদার মেটাতে রুবেল বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বিকাশ, নগদ, রকেটের মাধ্যমে টাকা পয়সা পাঠাতেন এবং বিভিন্ন দিবসের বিভিন্ন গিফট বা উপহার কেনার জন্য দায়িত্ব হিসেবে তিনি আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন।

কিন্তু হঠাৎ করেই সুমি তার স্বামী রুবেলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং সুমির পরিবারও রুবেলের সাথে কোন যোগাযোগ করে না। এমতাবস্থায় রুবেল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আকামা ঠিক করে দেশের উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠে। দেশে এসেই সে প্রথমে সুমিদের বাড়িতে যায় এবং গিয়ে দেখে সুমি বাড়িতে নেই। রুবেল এলাকাবাসীর কাছে নালিশ করলে সুমির বাবা মা রুবেলকে জানায় যে, সুমি রুবেলকে তালাক দিয়ে দিছে এবং সুমি অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে।

রুবেলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে খোঁজখবর নিয়ে দেখলো সুমি সত্যি সত্যি রুবেলকে তালাক দিয়েছে, যদিও তাদের বাড়িতে তালাকের নোটিশ যায়নি কিন্তু সালিশি পরিষদে ঠিকই নোটিশ পৌঁছানো হয়েছে ৩ মাসেরও বেশি সময় পূর্বে। সে অনুসারে তাদের মধ্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে গেছে।

রুবেল যখন সুমি এবং সুমির পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে চেয়ারম্যান, মেম্বারের কাছে নালিশ করতেছিল, ঠিক তখনি সুমি তার নতুন স্বামীর সহায়তায় আদালতে দেনমোহরের বাকি ৪ লক্ষ টাকা আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোবাইলে বা যেভাবেই বিবাহ সম্পন্ন হোক না কেন, যেহেতু স্বামী স্ত্রী একসাথে ছিল না বা সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলনে আবদ্ধ হয়নি, সেহেতু দেনমোহরের পুরো টাকা কি রুবেলকে পরিশোধ করতে হবে?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে, না।

দেনমোহর নারীর হক, স্বামী তালাক দিক বা স্ত্রী, স্ত্রীকে তার দেনমোহরের পুরো অর্থ পরিশোধ করতেই হবে। কিন্তু, যখন স্বামী স্ত্রী বিবাহের পর নিজেরা একসাথে বসবাস না করে বা বসবাস করলেও নিজেদের মধ্যে সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলনে আবদ্ধ না হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে পূর্ণ দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না।

পূর্ণ দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না?
না। বিবাহের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলন না ঘটলে এবং এরই মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক সম্পন্ন হয়ে গেলে স্বামী তার উক্ত স্ত্রীকে পরিশোধ করতে হবে দেনমোহরের অর্ধেক। অর্থাৎ, উপরের কাল্পনিক ঘটনা অনুসারে, রুবেল এবং সুমির মধ্যে যেহেতু বিবাহ সম্পন্ন হলেও সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলন ঘটেনি কিন্তু ডিভোর্স হয়ে গেছে, তাই রুবেল সুমিকে ৪ লক্ষ টাকার পরিবর্তে পরিশোধ করতে হবে দেড় লক্ষ টাকা।
মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনগুলো মুসলিম আইন অনুসারেই হয়ে থাকে। আর, মুসলিম আইনের প্রাইমারি বা প্রাথমিক সোর্সই হচ্ছে, পবিত্র আল কোরআন এবং হাদিস শরীফ। আল কোরআনে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে, মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে।”- এখানে স্পর্শের কথা বলা হয়েছে। স্পর্শ যদি না হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলনও সম্ভব নয়।

তাই, আমাদের এখন প্রচলিত চর্চা অনুসারে যদি স্বামী স্ত্রীর বিবাহের পর তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বেই তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়, তাহলে স্বামী স্ত্রীকে পূর্ণ দেনমোহরের পরিবর্তে পরিশোধ করতে হবে দেনমোহরের অর্ধেক। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, আর মোবাইলে পরিচয় হলে সেটি সঠিক যাচাই বাছাই না করে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকুন।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ডিভোর্স ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে: আইন কি বলছে?

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর আদ্যোপান্ত 

পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ এবং শাস্তির বিধান