যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮, এটি এমন একটি আইন, যা যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি ২০১৮ সাল থেকে কার্যকর। এই আইনে “পক্ষ” বলতে বর বা কনে এবং তাদের পরিবার বা অভিভাবকদের বোঝানো হয়েছে। “যৌতুক” বলতে বিবাহের সময় বা বিবাহের পূর্বে বর বা কনে পক্ষ থেকে অর্থ বা সম্পদ চাওয়া বা দেওয়া বোঝানো হয়েছে। তবে মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন, যদি কোনো বরের পরিবার কনের পরিবার থেকে বিয়ের সময় গহনা বা নগদ টাকা দাবি করে, তাহলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু দেনমোহর যৌতুকের মধ্যে পড়ে না, কারণ এটি ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী বরের দায়িত্ব।
যৌতুকের দাবি করার দণ্ড
যদি কেউ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যৌতুক দাবি করে, তাহলে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। যেমন, যদি কোনো বর কনের বাবার কাছে বিয়ের আগে একটি গাড়ি দাবি করে, এটি যৌতুক হিসেবে অপরাধ এবং তার জন্য শাস্তি হবে। তাছাড়া আরও যেভাবে যৌতুকের দাবি করা হয়ে থাকে তার কিছু উদাহরণ নিম্নে দেওয়া হলঃ
নগদ টাকার দাবিঃ ধরুন, বরের পরিবার বিয়ের শর্ত হিসেবে কনের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা নগদ দিতে বলছে। এটি সরাসরি যৌতুকের দাবি এবং এর জন্য আইন অনুযায়ী ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
সম্পত্তির দাবিঃ যদি বরের পরিবার কনের বাবাকে বলে, “আপনার জমি আমাদের নামে লিখে দিতে হবে বিয়ের আগে,” তাহলে এটি যৌতুকের একটি পরোক্ষ দাবি। এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য শাস্তি হবে।
ব্যবসার জন্য অর্থ দাবিঃ কোনো বর যদি বিয়ের পর কনের পরিবার থেকে ব্যবসা করার জন্য ১০ লক্ষ টাকা দাবি করে, তাহলে এটি যৌতুক হিসেবে অপরাধ। কনের পরিবার যদি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে বরের শাস্তি হতে পারে।
বিয়ের আয়োজনের জন্য চাপঃ যদি বরের পরিবার কনের পরিবারের ওপর বড় অংকের টাকা খরচ করে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে, এটি একটি পরোক্ষ যৌতুক দাবি। এর জন্যও আইনের অধীনে শাস্তি হতে পারে।
আসবাবপত্র বা গহনার দাবিঃ ধরুন, বরের মা কনের মায়ের কাছে বলে, “আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে আমাদের ঘরের জন্য নতুন আসবাবপত্র এবং কনের জন্য গহনা কিনে দিতে হবে,” এটি যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য বরের পরিবারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এইসব পরিস্থিতিতে যৌতুক চাওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে, যা আইন অনুযায়ী অপরাধ।
যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের দণ্ড
যদি কেউ যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে, অথবা যৌতুক দেওয়া-নেওয়া করতে সহায়তা করে, তাহলে এটিও অপরাধ। শাস্তি হিসেবে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি বিয়ের পর কনের পরিবার বরের পরিবারের চাপে নগদ টাকা দেয়, সেটিও অপরাধ এবং আইন অনুযায়ী এর জন্য শাস্তি হতে পারে।
যৌতুক সংক্রান্ত চুক্তি ফলবিহীন
যৌতুক দেওয়ার বা নেওয়ার যে কোনো চুক্তি আইনত বাতিল হবে। অর্থাৎ, যৌতুক চেয়ে যদি দুই পরিবারের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়, সেটি কোনো আইনগত মান্যতা পাবে না। অর্থাৎ, যদি বিবাহের আগে বা পরে যৌতুক চেয়ে বর ও কনের পরিবারের মধ্যে কোনো লিখিত বা মৌখিক চুক্তি হয়, সেটি আইন অনুযায়ী কোনো মর্যাদা পাবে না এবং সেই চুক্তি কার্যকর হবে না।
উদাহরণসমূহ: ধরুন, কনের বাবা একটি চুক্তি করেন বরের পরিবারের সঙ্গে, যেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে বিয়ের সময় তিনি বরের পরিবারকে নগদ ৫ লক্ষ টাকা এবং একটি মোটরবাইক দেবেন। এই চুক্তি যদি লিখিত হয়েও থাকে, যৌতুক নিরোধ আইন অনুযায়ী এটি অবৈধ হবে। অর্থাৎ, বরের পরিবার কোর্টে গিয়ে এই চুক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো দাবী করতে পারবে না।
মিথ্যা মামলা দায়েরের দণ্ড
যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা যৌতুক মামলা দায়ের করে, তাহলে তার জন্যও ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। যেমন, যদি কোনো কনে বা তার পরিবার মিথ্যা অভিযোগ করে যে বরের পরিবার যৌতুক দাবি করেছে এবং প্রমাণ হয় যে এটি মিথ্যা ছিল, তখন সেই কনের পরিবারের শাস্তি হতে পারে। যদি কেউ ভুলভাবে যৌতুক মামলা দায়ের করে বা কারও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এমন অভিযোগ আনে, যা প্রমাণিত হয় যে ভিত্তিহীন, তাহলে সেই ব্যক্তি বা পরিবারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ সমাজে অযথা ঝামেলা সৃষ্টি করে এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি করতে পারে, তাই আইন এ ধরনের কৌশলকে কঠোরভাবে দমন করে।
উদাহরণসমূহ:
ধরুন, কোনো কনের পরিবার বরের পরিবারকে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ করে যে বর যৌতুক দাবি করেছিল, কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হয় যে বরের পরিবার যৌতুক দাবি করেনি। এই ক্ষেত্রে কনের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের মামলা হতে পারে এবং তাদের ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
আবার ধরুন, কনের বাবা বিয়েতে খরচ করা অর্থের জন্য বরের পরিবার থেকে আরও টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে মিথ্যা যৌতুকের মামলা করেন। আদালতে প্রমাণ হয় যে বর বা তার পরিবার কখনো যৌতুক দাবি করেনি। এই মিথ্যা মামলার জন্য কনের বাবার শাস্তি হবে কারাদণ্ড বা জরিমানা।
আবার, যদি কোনো কনে বা তার পরিবার বরের সম্পত্তি বা ব্যবসা অধিকার করার লোভে যৌতুকের মিথ্যা অভিযোগ আনে এবং তদন্তে দেখা যায় যে অভিযোগটি ভিত্তিহীন, তাহলে কনের পরিবারকে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে।
আবার ধরুন, কোনো পারিবারিক বিরোধের কারণে কনের পরিবার ইচ্ছাকৃতভাবে বরের বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগ এনে মামলা করে, কিন্তু আদালতে প্রমাণিত হয় যে এটি মিথ্যা এবং বরের পরিবার কোনো যৌতুক দাবি করেনি। এই ক্ষেত্রে কনের পরিবারের শাস্তি হতে পারে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা।
অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিন অযোগ্যতা
যৌতুকের অপরাধ আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং আপোষযোগ্য। অর্থাৎ, যৌতুকের অপরাধ হলে পুলিশ সহজেই ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং অপরাধীকে জামিন পেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু, আপোষ করা যাবে।
অপরাধের বিচার
এই আইনের অধীনে অপরাধের বিচার ও তদন্ত ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ, যৌতুক সংক্রান্ত মামলাগুলো সাধারণ ফৌজদারি আদালতে চলবে।
আশা করি, যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ সম্বন্ধে একটা বেসিক ধারণা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে আমরা প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্। ধন্যবাদ।
 
				 
															 
				 
															 
															