২০২১ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৩৭ টি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে, যার মধ্যে গড়ে ৭০% আবেদন করছেন আমাদের মা বোনেরা। সবগুলো আবেদনই যে বিচ্ছেদে পরিণত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতাও হচ্ছে; তবে সংখ্যাটি অত্যন্ত হতাশাজনক। সমঝোতা হচ্ছে তালাকের আবেদনগুলোর মধ্যে গড়ে ৫% শতাংশেরও কম। বিচ্ছেদের আবেদনের মধ্যে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, সেগুলো প্রায় ঘুরে ফিরে একই। তালাক নোটিশের উপর চোখ ভুললে বিচ্ছেদের যে কারণ গুলো প্রায়শই দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে,
- যৌতুকের দাবীতে নির্যাতন,
- মাদক সেবক বা মাদকাসক্তি,
- সন্দেহবাতিক মনোভাব; অন্যের সাথে সম্পর্ক থাকা নিয়ে প্রতিনিয়ত সন্দেহ,
- পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক বা পরকীয়া,
- নারীর বন্ধ্যাত্ব বা পুরুষের পুরুষত্বহীনতা,
- রাগী বা বদমেজাজি,
- সংসার, সন্তানদের প্রতি উদাসীনতা,
- পরিবারের অবাধ্য হওয়া,
- ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুসরণ না করা ইত্যাদি।
এখন কথা হচ্ছে, তালাক কে দিতে পারে?
তালাক দেওয়ার ক্ষমতা একচেটিয়া পুরুষ তথা স্বামীর কাছে ছিল এতদিন, কিন্তু বর্তমানে স্ত্রীরাও তালাক দিতে পারে এবং নারীরাই বরং এখন তালাকে এগিয়ে। উপরে তো দেখলামই যে, রাজধানীতে তালাক আবেদনের ৭০%ই দিচ্ছে নারীরা। কাবিননামার ১৮ নাম্বার কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে থাকেন এবং প্রয়োজনে শর্ত আরোপ করতে পারেন যে কি কি শর্তে তালাক দিতে পারবেন। অতীতে স্বামী এই অধিকার না দিলে স্ত্রীদেরকে বিচ্ছেদের আবেদনের জন্য আদালতে যেতে হতো। এখন ১৮ নাম্বার কলামে স্বামীরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দিচ্ছে এক রকম বাধ্যতামূলক ভাবে। যার ফলে স্ত্রীরাও এখন চাইলেই স্বামীর মত তালাক দিতে পারেন।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকের পাশাপাশি স্বামী স্ত্রী দুইজন মিলে সমঝোতার ভিত্তিতেও তালাক দিতে পারেন, যাকে আমরা খোলা তালাক বলে জানি। এই তালাকে দুইজন একসাথে বসে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে তালাক দিয়ে থাকেন।
স্ত্রী তালাক দিলে কি দেনমোহর পাবে?
আমরা উপরে দেখলাম যে, তালাক ৩ ভাবে হতে পারে।
- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক,
- স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক,
- খোলা তালাক।
এখন তালাক উপরের ৩ উপায়ের যেভাবেই হোক না কেন, স্ত্রীকে তার দেনমোহর পরিশোধ করতেই হবে। স্ত্রী নিজে তালাক দিলে দেনমোহর দিতে হয় না, বলে যে কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা/ভুল। স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিক বা স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিক বা দুইজন মিলে খোলা তালাক দিক, স্ত্রীকে তার দেনমোহর পরিশোধ করতেই হবে। দেনমোহর হচ্ছে, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নারীর হক। এই হক থেকে তাকে কোন ভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না।
দেনমোহর আদায়ের মামলা করবেন কিভাবে
কাবিননামার ১৩ নাম্বার পয়েন্টে দেনমোহর কত টাকা নির্ধারণ করা হয় সেটি লিপিবদ্ধ থাকে। আর ১৪ নাম্বার পয়েন্টে, দেনমোহরের কি পরিমাণ মুয়াজ্জল এবং কি পরিমাণ মু’অজ্জল তা নিয়ে উল্লেখ থাকে। আমরা জানি, দেনমোহরের ২ টি অংশ রয়েছে, (১) মুয়াজ্জল (আশু) দেনমোহর (২) মু’অজ্জল (বিলম্বিত) দেনমোহর।
- মুয়াজ্জল বা আশু দেনমোহর হচ্ছে, স্ত্রী চাহিবামাত্র যে দেনমোহর পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য থাকে। এটি বিয়ের আসরে বা সংসার করা অবস্থায় যেকোনো সময় স্ত্রী চাইতে পারে।
- মু’অজ্জল বা বিলম্বিত দেনমোহর হচ্ছে, দেনমোহরের সেই অংশ যেটি স্বামী পরে দিতে পারে বা স্ত্রী চাইলে স্বামীর মৃত্যুর পর/স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা তালাকের পর আদায় করতে পারে।
আবার, কাবিননামার ১৫ নাম্বার পয়েন্টে, বিবাহের সময় দেনমোহরের কোন অংশ পরিশোধ করা হয়েছে কিনা সেটিও উল্লেখ থাকে।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চর্চা হচ্ছে, দেনমোহর যা নির্ধারণ করা হয়, তার মধ্যে বিয়ের সময় উশুল হিসেবে যা দেওয়া হয়েছে, সেটি বাদে বাকিটি স্ত্রীর বকেয়া হিসেবে থেকে যায়। সেই দেনমোহরের মধ্যে আশু দেনমোহরও অনেকেই মৃত্যু বা তালাকের আগে দাবী করে না। তাই সহজ ভাবে বললে, বিয়ের সময় দেনমোহর যা নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে কিছু পরিশোধ করার পর যা বকেয়া থাকে, সেটি স্ত্রী তালাকের সময় দাবী করতে পারে। স্বামী যদি সমঝোতার ভিত্তিতে দেনমোহর দিয়ে দেয় তবে ঝামেলা নেই, কিন্তু স্বামী যদি সমঝোতা বা আপোষে না দেয়, তবে পারিবারিক আদালতে দেনমোহর আদায়ের মামলা দায়ের করতে হবে।
দেনমোহরের মামলা কত দিনের মধ্যে করতে হবে?
তামাদি আইনের ১ম তফসিলের ১০৩ ও ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্ত্রী দেনমোহরের মামলা দায়ের করতে পারবেন ৩ বছরের মধ্যে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৩ বছরের গণনা কবে থেকে শুরু হবে?
- যখন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে দেনমোহর চাইবে কিন্তু স্বামী দেনমোহর পরিশোধে অস্বীকার করবে বা
- দেনমোহর বকেয়া রেখে স্বামীর মৃত্যু হলে বা
- দেনমোহর বকেয়া রেখে তালাক/বিবাহ বিচ্ছেদ হলে,
সেই দিন থেকে ৩ বছরের মধ্যে স্ত্রীকে দেনমোহরের মামলা করতে হবে। এরপর মামলা দায়ের করলে সেটি তামাদিতে বারিত হয়ে যাবে।
কখন স্ত্রী তার দেনমোহর অর্ধেকের বেশি পাবেন না?
মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনগুলো মুসলিম আইন অনুসারেই হয়ে থাকে। আর, মুসলিম আইনের প্রাইমারি বা প্রাথমিক সোর্সই হচ্ছে, পবিত্র আল কোরআন এবং হাদিস শরীফ। আল কোরআনে আল্লাহ্ বলেছেন, “আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে, মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে।”- এখানে স্পর্শের কথা বলা হয়েছে। স্পর্শ যদি না হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সহবাস বা শারীরিক সম্পর্ক বা দৈহিক মিলনও সম্ভব নয়। অর্থাৎ, বিবাহের পর যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক না হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রী পূর্ণ দেনমোহর পাবেন না। স্ত্রী তখন পূর্ণ দেনমোহরের অর্ধেক পাবেন। এই সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে আমাদের ওয়েবসাইটে আরেকটি পূর্ণ আর্টিকেল রয়েছে, চাইলে চোখ ভুলিয়ে আসতে পারেন। আজকে এই পর্যন্তই, আল্লাহ্ হাফেজ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )