স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিয়ে

পারিবারিক আইন

কলেজে পড়ার সময় সুমির সাথে তার পার্শ্ববর্তী গ্রামের ফারুকের সাথে পারিবারিক ভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়। ফারুক পেশায় একজন প্রবাসী। উল্লেখ্য সুমি কলেজে পড়লেও ফারুকের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই সামান্য। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে খুব অল্প বয়সে তাকে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। তাই পর্যাপ্ত পড়াশোনা করতে পারেনি। অন্যদিকে সুমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় এবং ছাত্রী হিসেবেও সে ভালো। তাই বিবাহের সময় সে স্বামীকে শর্ত দিয়েছিল যে, তাকে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা করাতে হবে। ফারুক যেহেতু পড়াশোনা করেনি তাই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সুমিকে পড়াশোনা করানোর জন্য অনুমতি প্রদান করে।

বিবাহের কয়েক মাস পর ফারুক আবার বিদেশ পাড়ি দেয় আর তার কিছুদিন পর কলেজ পাশ করে সুমি উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসে। ফারুকের পরিবার প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরবর্তীতে ফারুকের অনুরোধে এবং স্ত্রীকে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করে। মাস খানিকের মধ্যে সুমি ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তামিম নামের এক ছেলের প্রলোভনে পড়ে সুমি তাকে বিয়ে করে ফেলে। তামিমকে সে তার পূর্বের বিবাহের কথা জানায়নি। এদিকে ফারুক দিশেহারা হয়ে দেশে ফিরে আসে এবং সুমির পরিবারের মাধ্যমে জানতে পারে ঐ ছেলের প্রলোভনে পড়ে সুমি এই ভুল করে বসেছে। এখন আইনি প্রতিকার কি রয়েছে ফারুকের জন্য?

পৃথিবীতে মানুষের সাথে মানুষের সর্বপ্রথম যে সম্পর্কটি তৈরি হয় সেটি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক। জান্নাতে হযরত আদম (আঃ) এবং হযরত হাওয়া (আঃ) এর মধ্যে যে বিবাহ সম্পন্ন হয়, সেটি দুনিয়াতেও বলবৎ ছিল। যার ফলে আমরা দেখতে পারি মানুষের সাথে মানুষের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যে সম্পর্ক, সেটি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। এই কারণে এই সম্পর্কটিকে সকল ধর্মে খুবই শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সাথে বিবেচনা করা হয়। যদিও ইদানীং কালে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই সম্পর্কটি ধীরে ধীরে হাসি তামাশার পাত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কয়েকযুগ আগেও এই সম্পর্কটিকেই সবচেয়ে বেশি পবিত্র সম্পর্ক হিসেবে দেখা হতো। এই সম্পর্কটিকে বলবৎ এবং পবিত্র রাখার জন্য বহু ধরনের আইন ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে। এমনকি এই সম্পর্কের মধ্যে যাতে কোন তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করে এর পবিত্রতা নষ্ট করতে না পারে তার জন্যও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; যার একটি হচ্ছে স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিবাহ।
স্বামী স্ত্রী পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় অন্য কোথাও প্রকাশ্যে বা গোপনে বিবাহ করলে সেটিকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আমাদের দন্ডবিধি ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিবাহ করেন তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়েদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। যদিও উক্ত ধারার অপরাধ জামিন যোগ্য কিন্তু সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এটি একবার বিবেচনা নিলে বুঝতে পারবেন এটিকে কতটা গুরুতর অপরাধে হিসেবে চিন্তা করা হয়েছে, যেখানে চুরির শাস্তি মাত্র ৩ বছর।
তবে উল্লেখ্য, উক্ত ধারার অপরাধ মুসলিম এবং হিন্দু পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ আমরা জানি বিয়ে হচ্ছে ব্যক্তিগত আইনের বিষয় আর ব্যক্তিগত আইন হচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী নির্ধারিত। তাই মুসলিম আইনে একজন পুরুষ একই সময়ে একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারেন, যা সর্বোচ্চ ৪ জনের বেশী নয়। তাই, মুসলিম পুরুষের উপর এই আইনটি প্রযোজ্য হবে না। একইসাথে হিন্দু পুরুষের উপরও নয়। বাকি সবার ক্ষেত্রে এবং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারী এবং হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে এই বিধানটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

যে ধর্মেরই হোক না কেন, নারী কিন্তু একই সময়ে একাধিক স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বা থাকতে পারবে না। ব্যতিক্রম হিসেবে কিছু উপজাতি থাকতে পারে।

মুসলিম পুরুষদের জন্য একদম ছাড় রয়েছে তাও কিন্তু নয়। মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৬(৫) ধারা মতে, বিবাহিত মুসলিম পুরুষ তার বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করলে অপরাধ হবে। এক্ষেত্রে পূর্বে স্ত্রীর মৌখিক অনুমতি নেওয়া যথেষ্ট হলেও বর্তমানে সেটি লিখিত অনুমতি নিতে হয়। অর্থাৎ, আপনি একজন মুসলিম পুরুষ এবং আপনার একজন স্ত্রী রয়েছেন, সেক্ষেত্রে আপনি যদি পুনরায় বিবাহ করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার প্রথম স্ত্রী আপনাকে লিখিত অনুমতি দিতে হবে। কিন্তু অনুমতি না নিয়ে আপনি পুনরায় প্রকাশ্যে বা গোপনে বিবাহ করলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

তাছাড়া পুরো পৃথিবী এখন এক স্বামী-স্ত্রীতে বিশ্বাসী। ধর্ম যদিও একজন পুরুষকে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়, কিন্তু একাধিক স্ত্রীর প্রতি সমান দৃষ্টি প্রদর্শন করতে হবে। ইসলামের বিধানটি অনেকটা এমন যে,
আল্লাহ বলেন, তোমরা বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার। যদি আশঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে বিয়ে করো; সূরা নিসা, আয়াত ৩।
ইসলাম মুসলিম পুরুষকে একাধিক বিয়ের অনুমতি যেমন দেয় তেমনি প্রত্যেককে সমান দৃষ্টিতে দেখা বা সুবিচার করার শর্তও আরোপ করছে।

উপরিউক্ত শর্তটি মাথায় না রেখেই অনেকে একাধিক বিয়ে করে এবং পরক্ষণেই দেখা যায় যে, কোনও একজন স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। সাধারণত দেখা যায় যে একজন পুরুষ বিবাহ করার পরে কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিবাহ করে এবং প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানদের প্রতি দেখভাল করে না। খোঁজখবর রাখে না, ভরণপোষণ দেয় না; শুধুমাত্র দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকে মনোযোগ থাকে। আবার উল্টো চিত্রটিও আছে সমাজে; প্রথম বিবাহ করার পর ঝোঁকের মাথায় আবার দ্বিতীয় বিবাহ করে। সেক্ষেত্রে কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিবাহ যেটি রয়েছে, সেখানে স্ত্রী-সন্তানদের অবহেলা করেন। পুনরায় প্রথম সংসারে মনোনিবেশ করেন; এভাবেই চলতে থাকে।

প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না দিলেও স্বামী বলছে যে, প্রথম স্ত্রী অনুমতি দিয়েছে কিংবা প্রথম স্ত্রীর অনুমতি দিলেও পরবর্তীতে প্রথম স্ত্রী সেটি অস্বীকার করছে। যার ফলে বর্তমানে প্রথম স্ত্রীর লিখিত অনুমতি না দিলে দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবে না। তবে কেউ যদি মনে করে উভয়ের প্রতি ন্যায় বিচার করবেন, তাহলে অবশ্যই প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তারপর দ্বিতীয় বিবাহ করবেন।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.