নারীর ইচ্ছায় গর্ভপাত কি অপরাধ?

Abortion Policy

শামীম এবং রাবেয়া পরস্পর পরস্পরকে ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং যথাযথ আইন মেনেই বিবাহ সম্পন্ন করে। কিন্তু, আমাদের দেশে যেটা হয়ে থাকে যে, দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে বিয়ে করলে যে কোন এক পক্ষের পরিবার সেটি মেনে নিতে পারে না। এই ক্ষেত্রেও রাবেয়ার পরিবার শামীমকে মেনে নিতে পারেনি। কেননা, শামীম একটি ছোটখাটো চাকরি করে যেটি রাবেয়ার পরিবারের স্ট্যাটাসের জন্য অসম্মানজনক। তাই রাবেয়ার পরিবার সেই বিয়েটি মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু যেহেতু মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক এবং মেয়ের ইচ্ছেতেই বিয়ের সম্পন্ন হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তারা শামীমকে কোনভাবেই আইনগত জটিলতায় ফেলতে পারেনি। তবে তাদের যে অনেক অসৎ অসাধু উদ্দেশ্য ছিল না শামীমকে বিপদে ফেলার, তা কিন্তু নয়।
বিবাহের কিছুদিন পরে শামীমের আর্থিক সমস্যার কারণে যখন দুইজন কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল, তখনই রাবেয়ার বাবা-মা সুযোগটি কাজে লাগায়। পৃথিবীর এমন কোন পরিবার নেই, যে পরিবারে কখনো কোন সমস্যা হয়নি। প্রতিটি মানুষের জীবনে সমস্যা রয়েছে, কখনো সেটা মানসিক সমস্যা, কখনো সেটা শারীরিক সমস্যা, কখনো আর্থিক সমস্যা; কোন না কোন সমস্যা রয়েছেই। এই যে আমি এই আর্টিকেলটা লিখছি, দাঁতে ব্যথা নিয়ে লিখছি। এই যে আপনি পড়ছেন, আপনিও কোন না কোন সমস্যা নিয়ে পড়ছেন। আর আর্থিক সমস্যা নেই কার শুনি?

আর্থিক সমস্যা প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে, প্রত্যেকটি পরিবারে কখনো না কখনো থাকবেই। তবে মনে রাখবেন, কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু রাবেয়ার পরিবার শামীমের পরিবারের এই আর্থিক সমস্যাটিকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। তারা রাবেয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, বিয়ের মাত্র ছয় মাস যেতে না যেতেই এখনই আর্থিক সমস্যা, বাকি জীবন তুই কিভাবে এখানে পার করবি?
রাবেয়া শামীমের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং ভালোবাসা ছিল বলে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করেছিল কিন্তু কথায় আছে না, অভাব যখন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর এখনকার বেশিরভাগ মেয়েদের মত রাবেয়া ছিল ডেডিস প্রিন্সেস, তাই সেও এই অভাবের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে পরিবারের সাথে সুর মিলায় আর শামীমকে তার সমস্যাগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গা ক্যাসেটের শুনাতে থাকে।
এক পর্যায়ে রাবেয়া তার স্বামীকে ছেড়ে বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে ওঠে। রাবেয়ার বাবা-মা তখন তাদের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাবেয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাতে সে শামীমকে তালাক দিয়ে দেয়। রাবেয়া স্বামীর সংসারের আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে স্বামীকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে এসে কিছুদিন থাকতে পারলেও স্বামীকে তালাক দিবে, এটা সে মেনে নিতে পারছিল না।

এ যাত্রায় ব্যর্থ হয়ে রাবেয়ার বাবা-মা অন্য ফন্দি আটে, তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করে। উচ্চ শিক্ষার নাম দিয়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে রাজি করানো হয়। রাবেয়াও চিন্তা করে সে যদি বিদেশে চলে যায় তখন সেখানে সে পড়াশোনার পাশাপাশি যদি ওই দেশে প্রতিষ্ঠিত/সেটেল হতে পারে, তাহলে একসময় সে শামীমকেও বিদেশে নিয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটাই, ততদিনে রাবেয়া তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
এমতাবস্থায় বিদেশের মাটিতে গিয়ে পড়াশোনা করবে নাকি সন্তান লালন পালন করবে। তাছাড়া, আমরা জানি বাহিরের দেশে পড়াশোনা করতে গেলে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করা লাগে। এতকিছু একসাথে রাবেয়া কিভাবে সামাল দেবে?

 

এখন আপনার মাথায় যেটা ঘুরছে ঠিক সেটাই রাবেয়ার বাবা মায়ের মাথায় ঘুরছে। তাই রাবেয়ার বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ,সন্তানটিকে নষ্ট করে ফেলা অর্থাৎ গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করানো। শামীমের প্রতি ভালোবাসা দিন দিন রাবেয়ার মনে হচ্ছে এতটাই কমে গেল যে, গর্ভপাতের মত বিষয়টি পর্যন্ত রাবেয়া দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে এক কথায় বাবা-মার কথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সে আবেগ বশত হয়ে শামীমকে একবার জানায় যে, তার গর্ভে তাদের দুজনের যে সন্তান রয়েছে, সে সন্তানটিকে সে দুনিয়াতে আনতে চায় না, সন্তান তো চাইলে পরেও নেওয়া যাবে। আর সে নিজের ইচ্ছেতে যেহেতু গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করাবে, এখানে তার বাবা মায়ের কোন হাত নেই, সেহেতু এখানে আইনগত কোন জটিলতা নেই। এমতাবস্থায় শামীমের করণীয় কি বা শামীমের জায়গায় আপনি থাকলে আপনারই বা কি করার আছে?
এতোটুকু পরে আমাদের মনে রাবেয়ার বাবা-মা এবং রাবেয়ার প্রতি অনেক ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। এখানে চরিত্রগুলো যদিও কাল্পনিক কিন্তু একই প্রেক্ষাপটে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রাবেয়ার মতো কাউকে না কাউকে কখনো পড়াশোনার জন্য, কখনো শ্রমিক ভিসায় বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং গর্ভপাতের মত ঘটনাও ঘটছে। তাছাড়া, বিদেশ না পাঠিয়ে শুধু দেশে বসেও অবাধে এমন গর্ভপাত (MISCARRIAGE) হচ্ছে, যেখানে কোন অপরাধবোধই নেই।
এর কারণ হচ্ছে, আমরা মনে করি যে, যে নারী গর্ভ ধারণ করেছে তার যদি সম্মতি থাকে গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করানোর জন্য, সেক্ষেত্রে গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করানো কোন অন্যায় নয়। এ ধারণাটি ভুল।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩১২ ধারা অনুসারে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করায় এবং যদি সে গর্ভপাত (MISCARRIAGE) সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে, তবে সে ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে এবং যদি স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, তবে সে ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

ব্যাখ্যা (Explanation):- যে স্ত্রীলোক নিজেই নিজের অকাল গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করায়, সে স্ত্রীলোকও এই ধারার অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৩১২ ধারার ব্যাখ্যা পড়লে আমরা দেখতে পাই যে, কোন স্ত্রীলোক যদি নিজেই নিজের অকাল গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করায়, তাহলে তিনি নিজেও এই ধারার অধীন অপরাধী হবেন। অর্থাৎ, কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোক ইচ্ছাকৃত ভাবে যদি নিজের অকাল গর্ভপাত (MISCARRIAGE) ঘটান, যেখানে নিজের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্য ছিল না, তাহলে তিনি ৩ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থ দণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং যদি গর্ভবতী স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, তবে তিনি ৭ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
এখন শামীম চাইলে নিজের স্ত্রী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সকলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩১২ ধারার অধীন অভিযোগ আনতে পারেন। আর যদি এখনো গর্ভপাত (MISCARRIAGE) না করিয়ে থাকে, কিন্তু গর্ভপাত (MISCARRIAGE) করানোর সম্ভাবনা থাকে, তাহলে শামীমের উচিত রাবেয়াসহ তার পরিবারকে লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে উক্ত অপরাধের মাধ্যমে তার অনাগত সন্তানকে হত্যা না করার জন্য সাবধান করা। পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, থানা এবং সালিশি পরিষদে অভিযোগ করে উক্ত অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখা।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ডিভোর্স ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে: আইন কি বলছে?

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর আদ্যোপান্ত 

পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ এবং শাস্তির বিধান