এক স্বামীর সম্পত্তির মালিক যেভাবে আরেক স্বামী হচ্ছে

স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার

২০ বছরের দাম্পত্যের অবসান ঘটিয়ে সালমা বেগমের স্বামী রফিক সাহেব হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান। মৃত্যুকালে রফিক সাহেবের বয়স ছিল ৫০ বছর, অন্যদিকে সালমা বেগমের বয়স মাত্র ৪০ বছর।
এই বয়সেই সালমা বেগম বাকি জীবন একমাত্র ছেলে সন্তানকে নিয়ে কাটাতে পারবেন কি পারবেন না এই চিন্তায় যখন দিশেহারা তখন সালমা বেগমের পরিবার থেকে এক রকম জোর করেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে একজন পুরুষ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে থাকতে পারে। এতে সালমা বেগম নিজে তার বাকি জীবন এবং তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চলতে তেমন বেগ পেতে হবে না।

সালমা বেগমের প্রথম স্বামী অর্থাৎ রফিক সাহেব মারা যাওয়ার পর ওনার সম্পত্তি উনার একমাত্র ছেলে এবং স্ত্রীর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই স্বামীর মৃত্যুর পর যদি সন্তান থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রী পায় আট ভাগের এক ভাগ(১/৮) আর সন্তান না থাকলে পায় চার ভাগের এক ভাগ (১/৪)।
যেহেতু, রফিক সাহেবের সন্তান ছিল সেক্ষেত্রে সালমা বেগম আট ভাগের একভাগ সম্পত্তি পেলেন। এখন সালমা বেগম যাকে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তার নাম হচ্ছে সুমন। সুমন সাহেব অবিবাহিত মানুষ পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত কিছু কারণে এর আগে বিয়ে করা হয়নি; কিন্তু উনার বয়সও কম নয় ৪০, সালমা বেগমের সমবয়সী।
সালমা বেগমকে বিয়ে করার পর তিনি সালমা বেগমের সন্তানকে নিজের সন্তান রূপে গ্রহণ করে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। পৃথিবীতে মানুষ সবকিছুই হয়তো একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারলেও, অনেক সময় অন্যের জিনিস নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারলেও, কিছু কিছু বিষয় থাকে মানুষ যেগুলো একান্তই নিজের করে পেতে চায়। পৃথিবীতে নিজের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে।

মানুষ জানে সে সারা জীবন জীবিত থাকবে না, কিন্তু তার মৃত্যুর পরও তার কথা বলার জন্য, তার রক্ত বা বংশ পরম্পরা বহন করে নেওয়ার জন্য, সবারই চেষ্টা থাকে তার উত্তরাধিকার পৃথিবীতে রেখে যেতে। সেই চিন্তা থেকেই সুমন সাহেবের ইচ্ছা জাগলো নিজের একটি সন্তান জন্ম দেওয়ার।
যেই চিন্তা সেই কাজ, সুমন সাহেব সালমা বেগমকে জানালেন তার একটি সন্তান চাই। সালমা বেগম ইতিমধ্যে প্রায় মধ্য বয়সে পৌঁছে গেলেও উনার নিজেরও যে ইচ্ছে ছিল সুমন সাহেবের সাথে তার একটি সন্তান থাকুক সেটি তিনি গোপন করতে পারলেন না।
তাই উভয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে এই বয়সে সন্তানের জন্য চেষ্টা চালালেন। যখন কিনা সালমা বেগম এবং সুমন সাহেব উভয়েরই বয়স ৪৫ এবং সালমা বেগমের প্রথম সংসারের সন্তানের বয়স ২০।

ট্র্যাজেডি এখানেই, যার হায়াত যতদিন সে ঠিক ততদিনই বেঁচে থাকতে পারে; এর বাইরে এক সেকেন্ডও কেউ বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু সেই বিষয়টিকে আমরা সব সময় মাথায় না রেখে মৃত্যুর কারণগুলো অনুসন্ধান করে, ঐ কারণটিকে দায়ী করে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতে চাই।
কেননা আমার সময় শেষ এজন্য আমি চলে যাব, এটা আমাকে যতটা সান্ত্বনা দেয় তার চেয়ে বেশি সান্ত্বনা দেয় যদি নির্দিষ্ট একটি রোগ বা মানুষ বা কারণকে দোষারোপ করতে পারি। সালমা বেগমের ক্ষেত্রেও তাই হল, ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করার পরেও সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই বেশি বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণকে দোষারোপ করেছে কিন্তু যদি এটিই একমাত্র মৃত্যুর কারণ হত তাহলে ডাক্তাররা অবশ্যই সন্তান ধারণের জন্য নিষেধ করতেন।
যেভাবেই মৃত্যু হোক না কেন সালমা বেগম যখন মারা যান তখন উনার নবজাতক শিশুটিও মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ, মা সন্তান উভয়ই একই সাথে পরলোক গমন করেন। পড়ন্ত বয়সে বিয়ে করেও সুমন সাহেবকে বিপত্নীক হতে হল। গল্পটা এখানেই শেষ; তবে আইনি জটিলতা শুরু এখান থেকেই।

সালমা বেগম তার বাবার বাড়ি থেকে কোন সম্পত্তি পায়নি, নিজে যেহেতু গৃহিণী ছিলেন সে ক্ষেত্রে নিজের ক্রয়কৃত কোন সম্পত্তিও ছিল না। উনার সম্পত্তি বলতেই ছিল উনার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর ওনার সম্পত্তি থেকে আট ভাগের একভাগ সম্পত্তি।
এখন সালমা বেগমের ওই আট ভাগের এক ভাগ হিসেবে যে সম্পত্তি রয়েছে, সেই সম্পত্তির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে চলে যাবে তার সন্তান এবং দ্বিতীয় স্বামী সুমনের কাছে। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে, স্ত্রীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রীর সন্তান থেকে থাকে সেক্ষেত্রে স্বামী পাবে চার ভাগের একভাগ(১/৪) আর সন্তান যদি না থেকে থাকে তাহলে স্বামী পাবে অর্ধেক(১/২)।

এখন যেহেতু সালমা বেগমের নিজের সন্তান রয়েছে অর্থাৎ প্রথম ঘরে যে সন্তানটি রয়েছে সেটি তো সালমা বেগমের নিজের সন্তান। সেক্ষেত্রে সুমন সাহেব চারভাগের এক ভাগ(১/৪) সম্পত্তি পাবে, বাকি তিন ভাগ(৩/৪) পাবে ছেলে সন্তান।

এখন মজার বিষয় হল, সালমা বেগমের ঐ সম্পত্তিটি কিন্তু উনার প্রথম স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া। শুনতে অবাক লাগলেও স্ত্রীর প্রথম স্বামীর সম্পত্তি স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে এবং আমাদের উপরিউক্ত কাল্পনিক গল্পে সালমা বেগমের প্রথম স্বামীর সম্পত্তিতে সালমা বেগমের হাত ঘুরে সালমা বেগমের দ্বিতীয় স্বামীর কাছে যাচ্ছে।
এখানে অন্যায়ের কিছু নেই, কেননা একজন ব্যক্তি যখন উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পেয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সে সম্পত্তি একান্তই ঐ ব্যক্তির; অর্থাৎ সালমা বেগম প্রথম স্বামীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি পেয়েছে সেই সম্পত্তি একান্তই সালমা বেগমের নিজের। তাই ওনার মৃত্যুর পরে ওনার দ্বিতীয় স্বামী ঐ সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে অংশ পাবে।
এখানে কোনভাবেই কিন্তু প্রথম স্বামীর সম্পত্তি দ্বিতীয় স্বামী পাচ্ছে না, এটি প্রথম স্বামীর কাছ থেকে সালমা বেগমের কাছ যাচ্ছে, পরে সালমা বেগমের কাছ থেকে দ্বিতীয় স্বামীর কাছে যাচ্ছে। যদিও টেকনিক্যালি আমরা দেখছি যে, একই নারীর এক স্বামীর সম্পত্তি আরেক স্বামীর কাছে যাচ্ছে। কিন্তু মূলত সেটি আইন মেনেই একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে মালিকানা রদবদল হচ্ছে।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই