সৎ ভাইবোনদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ঠেকাতে করণীয়

সৎ ভাই-বোনের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার

রিনা বীণা দুই বোন। তাদের বাবা যাবের সাহেবের দুই সংসার। যাবের সাহেবের প্রথম স্ত্রীর দুই সন্তান, এক ছেলে এক মেয়ে। উনার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তিনি রিনা বীণার মাকে বিয়ে করেছিলেন। যাবের সাহেব এখনো জীবিত এবং তিনি রিনা বীণার মায়ের নামে অর্থাৎ যাবের সাহেব উনার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে কোনো জমিজমা এখনো পর্যন্ত লিখে দেননি। দ্বিতীয় স্ত্রীকে কিছু লিখে দেননি, সেটি সমস্যা না; সমস্যা হচ্ছে, যাবের সাহেবের প্রথম ঘরের ছেলে মারুফ তার সৎ বোন রিনা, বীণা এবং তাদের মাকে সহ্য করতে পারে না। মারুফ এদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাচ্ছে। এখন যাবের সাহেব জীবিত থাকার বদৌলতে মারুফ কিছু করতে পারছে না; কিন্তু এমন কিছু যে সে করবে সেটা নিজের মুখেই সে একাধিকবার উচ্চারণ করেছে।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, যাবের সাহেবের অনুপস্থিতিতে রিনা বীণা এবং তাদের মায়ের বাড়িতে থাকা মোটেও সম্ভব হবে না। পরিবারের বাকি সদস্যদেরও তেমন কোন ভূমিকা নেই। এখন রিনা বীণার আশঙ্কা হচ্ছে, যেহেতু তাদের ভাই নাই, তাই যাবের সাহেবের মৃত্যুর পর কি মারুফ তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে?

একজন পুরুষের প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করার পর যদি দ্বিতীয় বিবাহ করে সেক্ষেত্রে সে বিবাহটি নেহাতই নিরুপায় হয়ে করে থাকেন। দেখা যায় যে, প্রথম সংসারের সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্যই দ্বিতীয় বিবাহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমাদের দেশের যে সংস্কৃতি বা চর্চা, তাতে স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীরা পুনরায় বিবাহ না করলেও স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা পুনরায় বিবাহ করে থাকেন। এক্ষেত্রে যদিও অনেকেই জৈবিক চাহিদার বিষয়টিকে মুখ্য করে দেখেন, তবে একাকীত্বের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিবেচনায় স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুনরায় বিবাহ করাকে কটু দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলেও আমরা দেখতে পাবো, চরিত্র হেফাজত করার জন্য যে কোনও বয়সেই বিবাহ করাটাকে বৈধ ভাবে দেখা হয়। যদিও আজকাল আমাদের সমাজে বিবাহ কঠিন হয়ে গেছে, ব্যভিচার-পরকীয়া সহজ হয়ে গেছে।

এখন যাবের সাহেব প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তানদের লালনপালন বা নিজের জৈবিক চাহিদা কিংবা একাকীত্ব দূর করার জন্য পুনরায় বিবাহ করেছেন এবং সেই সংসারে দুটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। অস্বাভাবিক লাগলেও স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিটি সৎ ভাই বোনের মধ্যে অকৃত্রিম অসৎ আচরণ পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের সমাজে দেখা যায়, আমরা অনেক দূরের মানুষকে আপন করে নিতে পারি কিন্তু একই বাবার ভিন্ন মায়ের বা একই মায়ের ভিন্ন বাবার সন্তানদের আমরা কখনো আপন করে নিতে পারি না।

উপরের ঘটনার ক্ষেত্রে যাবের সাহেবের দ্বিতীয় সংসারের মেয়ে রিনা বীণা যে আশঙ্কায় রয়েছে, একই ধরনের আশঙ্কা আমাদের সমাজের অনেক ছেলেমেয়েই করে থাকেন; বিশেষ করে যখন তারা দেখে থাকেন তাদের সৎ ভাইবোন তাদের চেয়ে বয়সে বড়, ক্ষমতাধর এবং একই সাথে পরিবারের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার মতো কোনও অভিভাবক না থাকে।
তবে মন্দের ভালো হচ্ছে, এখানে যাবের সাহেবের দ্বিতীয় সংসারের মেয়ে বীণা এবং রিনার একটি সৌভাগ্য যে এখনও পর্যন্ত তাদের বাবা যাবের সাহেব জীবিত আছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পিতা মৃত্যুবরণ করেন বা উনার অনুপস্থিতিতে ওনার দুই সংসারের সন্তানদের মধ্যে বিবাদ লেগে থাকে। তাই কোনও ব্যক্তি যদি প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে বা প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পরে পুনরায় বিবাহ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ওনার উচিত হবে উনার জীবদ্দশায় উনার উভয় সংসারের সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তির সুষম বণ্টন করে যাওয়া। কেননা ওনার মৃত্যুর পরে সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে যে বিরোধ হবে সেটা বলাই বাহুল্য।

উপরের কল্পিত ঘটনাটিতে রিনা বীণা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, আমরা যদি এই সমস্যাটির সমাধানের পথ খুঁজি, সেক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাব যে যাবের সাহেবের উপস্থিতিতে অর্থাৎ উনার জীবিত অবস্থায় উনার প্রথম সংসারের সন্তান মারুফ, যাবের সাহেবের দ্বিতীয় সংসারের সন্তান রিনা বীণাকে এখনই সহ্য করতে পারছে না এবং সম্পত্তিতে ভবিষ্যতে ভোগদখল বা অধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই যাবের সাহেব জীবিত অবস্থায় উনার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি ওনার সন্তানের মধ্যে লিখিত ভাবে বণ্টন করে দেয়া উত্তম।
বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তির বণ্টন যদিও আইনানুগ ভাবে সমহারে বণ্টন হবে, কিন্তু বাটোয়ারা মামলায় আইনি জটিলতা কতটুকু সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে। যেখানে আপন ভাই বোনদের মধ্যে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক বাটোয়ারা মামলা চলতে থাকে, সেখানে সৎ ভাই বোনদের মধ্যে সেটি হয়ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলবে। তাছাড়া, সকল সম্পত্তির বাজার মূল্য সমান না। যার জোর বা ক্ষমতা বেশি সে ক্ষমতা খাটিয়ে জোর করে মূল্যবান সম্পত্তিটুকু আদায় করে নেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

যেমন ধরুন, যাবের সাহেবের ১০ শতাংশ জমি আছে এবং ১০ শতাংশের মধ্যে বসবাসের জন্য ৫ শতাংশ আর বাণিজ্যিক ৫ শতাংশ। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ৫ শতাংশ জমির মূল্য অনেক বেশি হবে। এক্ষেত্রে আশঙ্কা দেখা দিতে পারে যে, মারুফ ক্ষমতা দেখিয়ে মূল্যবান সম্পত্তিটি আদায় করে নিতে পারে। যার ফলে সম পরিমাণ সম্পত্তি পাওয়ার পরও যাবের সাহেবের দ্বিতীয় সংসারের মেয়ে রিনা বীণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই যাবে সাহেব বা যারাই দুই সংসার বা দুইটি পরিবারের কর্তা, তাদের উচিত হচ্ছে, উভয় সংসারের সন্তানদের মধ্যে অর্থাৎ সৎ ভাইবোনদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করার স্বার্থে জীবিত অবস্থাতেই মোট সম্পত্তির একটি সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

পিতা জীবিত অবস্থায়, সন্তানদের সুষম বণ্টন করে দিলে এবং সে অনুযায়ী কাগজপত্র করে দিলে ভবিষ্যতে সেটি নিয়ে তেমন বিরোধ হতে শোনা যায় না। তাই, বাবা জীবিত অবস্থাতেই হেবা দলিল বা অছিয়তের মাধ্যমেই দুই সংসারের সন্তানদের মধ্যকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ প্রতিহত করতে পারেন।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই