ওয়ারিশ বা সম্পদ না থাকলে উত্তরাধিকার বণ্টন প্রক্রিয়া

ওয়ারিশ না থাকলে বন্টন প্রক্রিয়া

কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু আমার কাছে মজার ছলে জানতে চাইলে, আমরা যে অনেক সময় সিনেমায় গল্প-উপন্যাসে দেখতে পাই যে কোন একজন ব্যক্তি যার দুনিয়াতে আপন বলে কেউ নেই, যদিও বাস্তবে এই ধরনের লোক খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল; কিন্তু তারপরেও যদি ঘটনাচক্রে সত্যিকার অর্থে এই ধরনের কোন ব্যক্তি পাওয়া যায় দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনো আত্মীয় স্বজন নেই কিন্তু ওই লোক যদি মৃত্যুর সময় কিছু সম্পত্তি রেখে যায় সেটা স্থাবর-অস্থাবর যাই হোক না কেন, সেই ক্ষেত্রে ঐ সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টন করলে কে মালিক হবে?

প্রথমে আমার কাছে যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটি হচ্ছে গিয়ে একেবারে কোন প্রকারের আত্মীয়-স্বজন নেই, এই ধারণাটা আসলেই ভুল। এমন হতে পারে যে সে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে এসেছে, যার কারণে তাঁর কোনো আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ আমরা জানি না। আমরা প্রায় দেখে থাকি যে, উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে বা দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ কাজের সুবাদে বা ঘটনাচক্রে চলে গিয়েছে আর ফিরে আসেনি; নিজের কর্মস্থলে যদি সে কোন ধরনের আত্মীয় স্বজন পরিবার তৈরি না করে থাকে অর্থাৎ অবিবাহিত থাকে, সেক্ষেত্রে তার যদি ওই জায়গায় কোন সম্পত্তি থেকে থাকে তাহলে ওই সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে আমরা আজকে আলোচনা করব।


মুসলিম আইন অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের যে হিসেবে রয়েছে সেখানে প্রথম দিকে শেয়ারার হিসেবে ১২ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই ১২ জনের মধ্যে যদি কেউ না থাকে তারপর আবার আসাবার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে, সে তালিকাতেও যদি কেউ না থাকে তখনই আমরা ধরে নিব যে, তার উত্তরাধিকার বলতে কেউ নেই। প্রথমত আপনাকে জানতে হবে শেয়ারার লিস্টে কে কে রয়েছে। মনে রাখার সুবিধার্থে শেয়ারারদের যে লিস্ট রয়েছে, সেই লিস্ট কে দুই ভাগে বিভক্ত করবো। আমরা পুরুষদেরকে একভাগে রাখছি, আরেক ভাগে নারীদেরকে রাখছে। আমরা সব জায়গায় জানি, লেডিস ফার্স্ট। শেয়ারার লিস্ট ৮ জন মহিলা রয়েছেন; তারা হচ্ছেন:

  •  মা
  •  মেয়ে
  •  স্ত্রী
  •  আপন বোন
  •  দাদী/নানী
  •  ছেলের মেয়ে/নাতনি
  •  বৈমাত্রেয় বোন
  •  বৈপিত্রেয় বোন

এরপর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে চারজন পুরুষ তারা হচ্ছেন:

  •  বাবা
  •  স্বামী
  •  দাদা (নানা পায় না)
  •  বৈমাত্রেয় ভাই।

এখন আপনাকে দেখতে হবে যে, এই ১২ জনের মধ্যে কেউ রয়েছে কিনা, যদি ১২ জনের মধ্যে কেউ না থেকে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আপনাকে যেতে হবে আসাবা তালিকাতে।
আসাবা তালিকাতে:

  •  ছেলে, ছেলে ছেলের, ছেলের ছেলের ছেলে এভাবে যতদূর পর্যন্ত নিচে নামা যায়
  •  পিতা, দাদা, দাদার বাবা এভাবে উপরে যতদূর যাওয়া যায়
  •  আপন ভাই, বৈমাত্রেয় ভাই, আপন ভাইয়ের ছেলে, বৈমাত্রিয় ভাইয়ের ছেলে,
  •  চাচা, বৈমাত্রীয় চাচা, চাচার ছেলে, বৈমাত্রীয় চাচার ছেলে



আসাবা তালিকাতে প্রথম সারির কেউ থাকলে বাকিরা সব বাদ, প্রথম সারি না থাকলে দ্বিতীয় সারি থাকলে বাকিরা বাদ। এইভাবে সিরিয়ালে প্রথমেই যাদের পাওয়া যাবে তারাই কেবল পাবে, বাকিসব বাদ। এবার আসুন থিউরিতে।
পৃথিবীতে বাবা মা ব্যতীত একমাত্র আদম (আঃ) এবং মা হাওয়া (আঃ) জন্ম পৃথিবীতে এসেছিলেন। এর বাহিরে কেউই পিতা-মাতা ব্যতীত পৃথিবীতে আসেনি। সবারই বাবার পরিচয় অথবা মায়ের পরিচয় রয়েছে; বিশেষ করে মায়ের পরিচয় থাকবেই। এখন কোন ব্যক্তির যদি আত্মীয় স্বজন বলতে উপরে আমরা যতজনের আলোচনা করেছি, তাদের যদি কেউই না থেকে থাকে, তাহলে আমাদের সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে বিপত্তি তৈরি হবে। কিন্তু এখনকার যুগে এই বিষয়টা নিয়ে সমস্যায় পড়ার কথা নয়। কারণ আমাদের সকলেরই এখন একটি পরিচয় পত্র রয়েছে, যে ব্যক্তির কোন সম্পত্তি রয়েছে তার অবশ্যই পরিচয় পত্র রয়েছে। কেননা এখন পরিচয় পত্র ব্যতীত কোন সম্পত্তি ক্রয় করা যায় না বা মালিকানা অর্জন করা যায় না। এখন কোন ব্যক্তির যদি আমরা উপরের তালিকার কোন সম্পর্কিত লোকে খুঁজে না পাই, সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে ঐ ব্যক্তির পরিচয় পত্র খুঁজে অবশ্যই তার আত্মীয়দেরকে বের করতে হবে। তারপর তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক অনুপাতে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন করে দিতে হবে। যদিও আমাদের দেশে এই কাজের জন্য কষ্ট করার কোন প্রয়োজন হয় না। অবিবাহিত বা নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টন এর জন্য যারা যারা সম্পত্তি পাবে তারা আগে থেকেই ওৎপেতে বসে থাকে এবং অপেক্ষা করে কবে ঐ ব্যক্তি মারা যাবে আর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি তারা ভাগ বসাতে পারবে। তারপরও শুধুমাত্র জানার জন্যই জানা, একেবারে স্ট্রেঞ্জার কোন ব্যক্তি যদি থেকে থাকে যার কোন ধরনের আত্মীয়-স্বজন খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু তার নামে কিছু সম্পত্তি রয়েছে সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি তার মৃত্যুর পরে সে যদি কাউকে কিছু দিয়ে না গিয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তির মালিকানা চলে যাবে সরকারের কাছে।

এবার আসুন, যার কোন সম্পত্তি নেই তাকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। এতক্ষণ আলোচনা করলাম যার কোন ওয়ারিশ নেই, এখন আমরা আলোচনা করব ওয়ারিশ আছে কিন্তু সম্পত্তি নেই, এ ধরনের উদাহরণ একেবারে বিরল নয়। অনেক ব্যক্তি রয়েছে যার পৈতৃক সূত্রে বা কতটুকু সম্পত্তি ছিল তার পুরোটাই হয় সে জীবদ্দশায় তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছি অলরেডি অথবা বিক্রয় করে ফেলেছে, এই ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যক্তি যাদের কোনো ধরনের সম্পত্তি অবশিষ্ট নেই, তার মৃত্যু কালে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে বণ্টন এর প্রয়োজন হবে না। বোবার কোন শত্রু নেই, যে কথা বলতে পারে না, তার কোন শত্রুও নেই। যার কোন সম্পত্তি নেই, তার উত্তরাধিকারী সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের কোন প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে ছোট্ট একটা তথ্য দিয়ে আজকে শেষ করতে চাই, সেটা হচ্ছে গিয়ে কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার উত্তরাধিকারী সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বে তার যত ধরনের দেনা পাওনা রয়েছে সেগুলো পরিশোধ করতে হবে। বাহিরে যত ঋণ রয়েছে সেগুলো পরিশোধ করতে হবে পাশাপাশি সে যদি তার স্ত্রীর দেনমোহরের অর্থ পরিশোধ করে না থাকে তাহলে আগেই স্ত্রীর দেনমোহরের অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন করার সময় আমরা একটা জট লাগিয়ে ফেলি, সেটা হচ্ছে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাচ্ছে আবার দেনমোহর কেন? আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, দেনমোহর হচ্ছে নারীর বৈবাহিক হোক, সেটা বিয়ের সময় এই হক তৈরি হয় আর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির হক হচ্ছে স্বামীর মৃত্যুর পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে সৃষ্টি হওয়া হক; দুইটা আলাদা আলাদা হক।

আশা করি বুঝতে পেরেছেন, তারপরও কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে আমাদেরকে ইমেইল করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই