পৃথিবীতে প্রতিদিনই কতো মানুষ জন্ম নিচ্ছে আবার একই সাথে কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের আগেও অনেকেই এই পৃথিবীতে এসেছে, আবার আমাদের পরেও অনেক প্রজন্ম আসবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সবাইকেই একে একে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। পৃথিবীতে আমরা যারাই বসবাস করছি, তারা প্রত্যেকেই কারো না কারো সন্তান আবার আমাদের পরে যারা আসবে তারাও আমাদেরই সন্তান। একটা চেইনের মাধ্যমেই আমাদের মানব জাতি এখনো পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মিছিলে আমরা কেউই নিঃস্বার্থবান নই, প্রত্যেকেই নিজ নিজ নাম এবং ধন সম্পদ নিজের রক্তের কাছে রেখে যেতেই এই দুনিয়াতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছি। আমার পরে আমার ছেলে আমার সকল সম্পত্তির দেখভাল করবে, এই মানসিক না থাকলে মানুষ দুনিয়াতে সম্পত্তি নিয়ে এতো আগ্রহী হতো না। হয়ত এই আগ্রহের কারণে অনেক লড়াই হচ্ছে, কিন্তু পক্ষান্তরে পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়ার পথে এই সম্পত্তি লাভের আগ্রহই বেশি ভূমিকা রেখেছে। এই বিতর্ক বাদ দিলে, সম্পত্তি যেভাবেই অর্জিত হোক, উক্ত সম্পত্তি আমরা ইহকাল ত্যাগের পূর্বে সকলেই নিজ রক্তের বৈধ উত্তরাধিকারের নিকট হস্তান্তরিত হবে, এটা অন্তত নিশ্চিত করতে চাই। আর এজন্যই মানুষ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে সম্পদ একান্ত নিজের তত্ত্বাবধানে রাখা যায়। নিজের জীবদ্দশায় তো সম্পদ নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু নিজের মৃত্যুর পরও যেন সম্পদ নিজের আপনজনেরা ভোগ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করে যাওয়ার একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাও সবার মাঝে কাজ করে। আর, পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ পড়ন্ত বয়সে তার সারাজীবনের উপার্জিত বা ভোগকৃত সম্পত্তি তার অবর্তমানে তার সন্তানদেরকেই তার স্থলে দেখতে চায়। যার ফলশ্রুতিতে মানুষ সন্তানদেরকে আদর-সোহাগ, মায়া-ভালোবাসা করতে ছেলে মেয়ের মাঝে কোন পার্থক্য না করলেও সম্পত্তির বেলায় সর্বদা ছেলে সন্তানকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। ছোট বেলা থেকে একটা ছেলের তুলনায় একটা মেয়ে অনেক বেশি আদর সোহাগ স্নেহে বড় হয়। বলা হয়ে থাকে, একটা মেয়ে শিশু ছোট বেলায় যতগুলো পাপ্পি(চুমু) খেয়ে বড়, ততগুলো পাপ্পি তো একটা ছেলের কপালে জুটেই না, বরং তার চেয়ে অনেক থাপ্পড় খেয়ে একটা ছেলে শিশুর শৈশব কাটে। তারপর, একটা ছেলেকে লালন পালন করে বড় করতে যত খরচ হয়, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি খরচ হয় একটা মেয়ে শিশুকে তার শৈশব থেকে কৈশোরে পৌছাতে। বাবা মায়ের কোন কমতি থাকে না কন্যা সন্তানকে লালন পালন করতে বা তার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে। এমনকি বিয়ে দেওয়ার বেলাতেও মেয়ের বেলাতে খরচ করতে কার্পণ্য করে না বাবা মায়েরা। কিন্তু পুরো সমস্যাটা তৈরি হয়, যখন দেখা যায় বাবা মায়ের কোন ছেলে সন্তান থাকে না। ছেলে না থাকলে কেবল মেয়ে থাকলে সম্পত্তি বাহিরে চলে যায়, এটা মোটামুটি সকলেই জানে। কিন্তু, কীভাবে, কেন এবং কতোটুকু সেটা নিয়ে অনেকেই অবগত নয়।
প্রথমত, ছেলে সন্তান না থাকলে যদি কেবল একটি মেয়ে থাকে তাহলে সে পাবে অর্ধেক সম্পত্তি আর যদি একের অধিক মেয়ে থাকে তবে তারা সকলে মিলে ২/৩ (দুই তৃতীয়াংশ) পাবে। একের অধিক বোনদের ক্ষেত্রে উক্ত ২/৩ অংশ, তাদের নিজেদের মধ্যে সমান হারে বণ্টন হবে। বাকী সম্পত্তি অন্য শেয়ারার বা আসাবা লিস্টে যারা আছে তাদের কাছে চলে যাবে। যেমন, মেয়েদের দাদা, চাচা, চাচাতো ভাই ইত্যাদি। তবে, কেউই যদি না থাকে তবে তখন মেয়েরা কিন্তু পুরো সম্পত্তিরই মালিক হবে। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ না কেউ থাকে। তাই, মেয়েদের কাছে বাকী সম্পত্তি ফেরত আসে না। এই জটিলতার জন্যই, সকল স্বামী স্ত্রীই চায় তাদের যেন একটি হলেও ছেলে সন্তান থাকে। আর, পুত্র সন্তানহীন বাবা মায়েরা সবসময়ই চায় সম্পত্তি যেন মেয়েদের থেকে হাত ছাড়া হয়ে অন্য কারো কাছে চলে না যায়। এজন্যই যতো দুশ্চিন্তা।
এই দুশ্চিন্তা দূর করতে কেউ কেউ, জীবিত অবস্থায় মেয়েদের নামে পুরো সম্পত্তি হেবা করে দিয়ে যায়। কিন্তু, হেবার একটা সমস্যা হচ্ছে, হেবা করলে আপনি জীবিত অবস্থাতেই আপনার মেয়ে চাইলে আপনার সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করে ফেলতে পারে। তাছাড়া, আপনার বৃদ্ধ বয়সে আপনার মেয়ে আপনার ভরণপোষণ বা দেখভাল তো নাও করতে পারে। মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলা দেওয়া কিন্তু বোকামি।
অনেকেই আবার আছেন, সম্পত্তি মেয়েদেরকে হেবা করে দিয়ে থাকেন, পরে আবার মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি/আমমোক্তারনামা নিয়ে রাখেন যাতে সম্পত্তি মেয়েদের নামেই থাকলেও সম্পত্তির যাবতীয় আইনানুগ ক্ষমতা বাবার কাছে থাকলো। এটাও একটা ভালো সমাধান; তবে এটাতেও সমস্যা আছে। মেয়েরা চাইলে পাওয়ার অফ এটর্নি/আমমোক্তারনামাটি বাতিল করে দিতে পারে। তখন, বাবা সম্পত্তির ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবেন।
তাহলে, কি করা যেতে পারে? অছিয়তকে এখনো অনেকেই মোটামুটি নিরাপদ মনে করেন এই সমস্যা সমাধানের জন্য। মনে রাখতে হবে, উইল আর অছিয়তে সামান্য পার্থক্য আছে। অন্যান্য ধর্মে পুরো সম্পত্তিই উইল করা গেলেও মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে উইল করা যায় ১/৩(এক তৃতীয়াংশ)। অন্য দিকে অছিয়তে এমন বিধিনিষেধ নেই; তবে, ওয়ারিশের সম্মতি থাকতে হবে অছিয়তে এবং বণ্টনের হার নিয়েও সকলে সম্মতি প্রদান করতে হবে। কেউ একজনও যদি তার অংশের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি করে, তখন কিন্তু সেটা আর সম্পাদন করা সম্ভবপর হবে না। তবে যেহেতু শুধু মেয়েদের মাঝে অছিয়ত, সকলকে সমান ভাগে ভাগ করে দিলে তাদের মাঝে আপত্তি থাকার কথা নয়। তাছাড়া, অছিয়ত করার পরও বাবা কিংবা মা, যিনিই মূলত সম্পত্তির মালিক তিনি চাইলে নিজ প্রয়োজনে সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন, এতে আইনানুগ কোন বাঁধা নেই। অছিয়ত কীভাবে করতে হয়, খরচ কতো, সেসব নিয়ে অন্য কোন দিন বিস্তারিত লিখবো।
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )