চার (০৪) পর্বের এই সিরিজের শেষ পর্বে এসে আমরা জানার চেষ্টা করব, কিভাবে একজন সম্ভাব্য অভিভাবক একজন নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। আমরা পূর্বে জেনেছি যে, নাবালকের পিতা নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক; অতএব পিতাকে আদালতে কোন প্রকারের আবেদন করতে হবে না। কিন্তু বাকিদেরকে The Guardians and Wards Act. 1890 (গার্ডিয়ান এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০) এর ৮ ধারা অনুযায়ী আদালত দরখাস্ত করতে হবে। আবেদন করার পর আদালত সেই দরখাস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এবং প্রয়োজন মনে করলে আবেদনকারীকে নাবালকের এবং নাবালকের সম্পত্তির কল্যাণের জন্য অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন আবার উক্ত আবেদন খারিজ করে দিতে পারেন। কোন নাবালকের অভিভাবক জন্য যদি আবেদন করে উক্ত আবেদন খারিজ হয়ে যায় বা কাউকে অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করা না হয়, সে ক্ষেত্রে ওই নাবালক ব্যক্তির ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধক দিতে পারবেন না। কিন্তু নাবালক আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হলেই সে সাবালক হবে, তখন সে নিজেই তার নিজের সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু, The Majority Act 1875 (দি মেজরিটি এক্ট, ১৮৭৫) এর ৩ ধারা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নাবালক থাকবেন, তবে যে নাবালকের শরীর বা সম্পত্তি বা উভয়ই আদালত কর্তৃক নিযুক্ত কোন অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়কের অধীনে আসে, সে নাবালকের বয়স ২১ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি নাবালক থাকবেন, সাবালক হিসেবে গণ্য হবেন না। অর্থাৎ, এমনিতে নাবালক ব্যক্তির সাবালক হবে ১৮ তে, কিন্তু যখন নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ করা থাকবে তখন নাবালক ব্যক্তির সাবালক হবেন ২১ বছর বয়সে।
দ্বিতীয় পর্বে আমরা জেনেছিলাম যে, বাবা-মা ছাড়াও যারা অভিভাবক হতে পারেন তাদের তালিকা। এবার আমরা দেখব, ওই লিস্টের মধ্যে কেউ বা নাবালকের যেকোনো ধরনের আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব উক্ত নাবালকের অভিভাবক হওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করলে আদালত কি কি বিষয় বিবেচনায় নেবেন। যদিও বিষয়টি জোরালো ভাবে প্রাসঙ্গিক নয়, তারপরও আপনি যদি একজন আবেদনকারী হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনার মধ্যে কি কি গুনাগুণ থাকলে এবং নাবালকের কোন কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আদালত আপনাকে অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করতে পারে সেই বিষয়টা যাচাই করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট মাথায় রাখতে পারেন।
প্রথমত, আদালত তাকেই নাবালকের অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করলেন যার মাঝে নাবালকের কল্যাণ নিহিত। নাবালকের কোন প্রকারের অকল্যাণ হতে এমন ব্যক্তিকে কখনো তার অভিভাবক হিসেবে আদালত নিয়োগ করবেন না।
দ্বিতীয়ত, নাবালকের বয়স, ধর্ম এবং জেন্ডার/লিঙ্গ এই তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে কোন ব্যক্তি নাবালকের জন্য যোগ্য অভিভাবক হবেন সেই বিষয়টি বিবেচনা করবেন। বাবা-মা একজন বা উভয়ই যদি মৃত হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে ওনাদের শেষ ইচ্ছা বা ঐ জাতীয় কিছু যদি থেকে থাকে সেই ক্ষেত্রে শেষ ইচ্ছা অনুসারে ও অভিভাবক নিয়োগ করা হতে পারে বা আদালত সেটাকে কিছুটা গুরুত্ব দিতে পারেন। তারপর আবেদনকারী নিজে কতটা চরিত্রবান, আর্থিকভাবে কতটা সক্ষম এবং আবেদনকারী এবং নাবালকের মধ্যকার সম্পর্ক সেটা কতটা ঘনিষ্ঠ সেই বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখবেন। তাছাড়া, আবেদনকারীর সাথে নাবালকের বা নাবালকের সম্পত্তির সঙ্গে অতীত এবং বর্তমান কোন সম্পর্ক থাকলে সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখবেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, নাবালকের যদি ততটুকু বুদ্ধিমত্তা থাকে বা নিজের কোন ইচ্ছা জানানোর সক্ষমতা থাকে, তাহলে সেটি নাবালক আদালতকে জানালে আদালত সেই বিবেচনায় নাবালকের ইচ্ছে অনুযায়ী অভিভাবক নিয়োগ করতে পারে। তবে মাথায় রাখতে হবে, পুরো বিষয়টি হচ্ছে আদালতের এখতিয়ারাধীন। অর্থাৎ, আদালত যাকে নাবালকের অভিভাবক হিসেবে ভালো মনে করবেন কেবলমাত্র তাকেই অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন।
এতক্ষণ তো জানলাম মুসলিম আইন অনুসারে, নাবালকের অভিভাবকত্ব নিয়ে। এবার আসি জানুন, হিন্দু আইন অনুসারে নাবালকের অভিভাবকত্ব নিয়ে। হিন্দু আইনে নাবালকের অভিভাবক ৩ প্রকারে ভাগ করা হয়ে থাকে।
প্রথমত, মুসলিম আইনের মত হিন্দু আইনেও নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক পিতা। কিন্তু, পিতা জীবিত যদি না থাকলে সে ক্ষেত্রে নাবালকের মাতা নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক হতে পারবেন। নাবালকের মাতা নাবালকের পিতার অবর্তমানে স্বাভাবিক অভিভাবক হবে, যেটা মুসলিম আইনের ব্যতিক্রম; এমনকি পুনরায় বিবাহ করলেও এই অভিভাবকত্ব হারাবেন না। কিন্তু এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, পিতা যদি জীবিত অবস্থায় উইলের মাধ্যমে কোনো অভিভাবক নিযুক্ত করে দিয়েছেন সে ক্ষেত্রে পিতার মৃত্যুতে মা জীবিত থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিক অভিভাবক হতে পারবেন না। পিতার অবর্তমানে পিতার নিযুক্ত ব্যক্তি নাবালকের অভিভাবক হবেন, এটি হচ্ছে হিন্দু আইনে নাবালকের অভিভাবক হওয়ার দ্বিতীয় উপায়। তাছাড়া, আদালতের মাধ্যমে নাবালকের অভিভাবক নিযুক্ত করা যায়। প্রথম দুই উপায়ের অনুপস্থিতিতে তৃতীয় উপায়ে হিন্দু আইনে নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ করা যাবে আর নাবালকের বয়সের যে ব্যপারগুলো রয়েছে সেগুলো হিন্দু-মুসলিম উভয় আইনের ক্ষেত্রেই সমান থাকবে।
সেফটি ক্লজ, সব শেষে আসুন এবার জানি যদি নাবালকের অভিভাবক নাবালকের সাথে প্রতারণা করে বা নাবালকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে সেক্ষেত্রে নাবালকের জন্য আইনি প্রতিকার কি?
কোন ব্যক্তি যদি আদালত কর্তৃক আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পরও নাবালকের মঙ্গলার্থে বা নাবালকের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করে বা বন্ধক রাখে না অন্য যেকোনো ধরনের হস্তান্তর করে থাকে, সেই ক্ষেত্রে নাবালক ব্যক্তি সাবালক হবার তিন বছরের মধ্যে ওই হস্তান্তর বাতিল করার জন্য আদালতে মামলা করতে পারবেন। অর্থাৎ কোনভাবে নাবালকের আইনানুগ অভিভাবক হয়ে নাবালকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার কোন প্রকারের উদ্দেশ্য যদি থেকেও থাকে সেটিও কিন্তু বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কেননা নাবালকের তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছে সাবালক হওয়ার পরে মামলা করার জন্য। অর্থাৎ নাবালক চাইলেই নাবালক থাকা অবস্থায় তার অভিভাবক তার সম্পত্তি যেখানেই হস্তান্তর করুক না কেন সেটি যদি তার স্বার্থে বা মঙ্গলার্থে করা না হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে নাবালক সেটি মামলা করে উক্ত হস্তান্তর বাতিল করতে পারবে এবং নিজের সম্পত্তি নিজের কাছে ফেরত নিয়ে আসতে পারবেন। সম্পত্তি হস্তান্তর বাতিলের বিষয়টি দেওয়ানী মামলা অন্তর্ভুক্ত। নাবালক ব্যক্তির সাবালক হওয়ার পর দেওয়ানী মামলার পাশাপাশি দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর অধীনে ফৌজদারি মামলাও করতে পারবেন।
আশা করি, ৪ পর্বের এই সিরিজ থেকে নাবালকের অভিভাবক হওয়া, নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি, বন্ধক বা হস্তান্তর করা ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে পেরেছি। পাশাপাশি জানতে পেরেছি, অভিভাবক নাবালকের সম্পত্তি নিয়ে কোন প্রকার প্রতারণা করলে নাবালকের আইনি প্রতিকার নিয়ে। এরপরও কারো কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে জানাতে পারেন, আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবো আরও তথ্যবহুল করে আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরতে। ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ হাফেজ।
[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ ]
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )