রিয়াজ উদ্দিন একজন সরকারি কর্মকর্তা। সারা জীবন পরিশ্রম করে তিনি ব্যাংকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা জমিয়েছিলেন। তিনি ব্যাংকে একাউন্ট খোলার সময় তার বড় ছেলে রাকিবকে নমিনি করেছিলেন, কারণ তখন তার ছোট ছেলে মাত্র পাঁচ বছর বয়সী ছিল। স্ত্রীকেও তিনি তখন নমিনি করেননি, কারণ তিনি মনে করেছিলেন বড় ছেলে পরবর্তীতে তার মা ও ছোট ভাইয়ের খেয়াল রাখবে।
কিন্তু জীবন সবসময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না। রিয়াজ সাহেব হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর যখন ব্যাংকে তার টাকা উত্তোলনের প্রশ্ন আসে, তখন দেখা গেলো, রাকিবই একমাত্র নমিনি হিসেবে নির্ধারিত। ছোট ভাই এবং মা টাকা থেকে কোনো ভাগ পাবেন না। এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়, মামলাও হয়। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর কিছুটা সমাধান হলেও পরিবারটি বড় ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়।
এই সমস্যা এড়ানোর সহজ সমাধান হচ্ছে, নমিনি নির্ধারণ করার সময় সতর্ক থাকা এবং পরিকল্পিতভাবে নমিনি বাছাই করা। আজকের আলোচনায় আমরা জানবো, কিভাবে সঠিকভাবে নমিনি নির্ধারণ করলে ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা সৃষ্টি হবে না।
ব্যাংক একাউন্টের নমিনি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলার সময় সাধারণত নমিনি নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয়। নমিনি হলো সেই ব্যক্তি, যিনি একাউন্টধারীর মৃত্যুর পর একাউন্টের টাকা গ্রহণ করবেন। তবে, নমিনি বিষয়ক কিছু ভুল ধারণা ও অসচেতনতার কারণে অনেক সময় পরিবারে সমস্যা দেখা দেয়।
১. নমিনি মানেই উত্তরাধিকারী নয়
অনেকেই মনে করেন, যাকে নমিনি করা হয়েছে, তিনি ঐ মৃত ব্যক্তির পুরো সম্পত্তির একক মালিক হয়ে যান। এটি ভুল ধারণা। নমিনি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি যিনি একাউন্টধারীর মৃত্যুর পর উক্ত ব্যাংক থেকে টাকা গ্রহণের অধিকার পাবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি মৃত ব্যক্তির পুরো সম্পত্তির একমাত্র মালিক হবেন।
২. একাধিক নমিনি করা যায়
অনেকেই জানেন না যে, নমিনি একজনের বেশি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি আপনার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়েকে নমিনি করতে চান, তাহলে আপনি চাইলে তিনজনকেই নমিনি করতে পারেন। ব্যাংকে আপনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারবেন, কে কত শতাংশ টাকা পাবেন। উদাহরণস্বরূপঃ
স্ত্রী: ৫০%, ছেলে: ২৫%, মেয়ে: ২৫%। আপনি যদি এই অনুপাতে নমিনি নির্ধারণ করে যান, তাহলে আপনার মৃত্যুর পর পরবর্তীতে টাকা বণ্টন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এই অনুপাতটি আপনি একাউন্ট খোলার সময় নিজের ইচ্ছে মত কমবেশি করতে পারবেন।
৩. নমিনি না করলে কী সমস্যা হয়?
যদি নমিনি নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে একাউন্টধারীর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট, ওয়ারিশ সনদ, ফারায়েজ অনুযায়ী কে কতটুকু পাবে সেই অনুযায়ী সাকসেশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি নিয়ে জমা দিলেো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪. দত্তক সন্তান ও নমিনি
বাংলাদেশের উত্তরাধিকার আইনে দত্তক সন্তান বাবা-মায়ের সম্পত্তির স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী নয়। ফলে, যদি আপনি চান যে আপনার দত্তক সন্তান আপনার মৃত্যুর পর আপনার সম্পত্তি পায়, তাহলে তাকে নমিনি হিসেবে নির্ধারণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
৫. অপরিচিত কাউকে নমিনি করা যায় কি?
হ্যাঁ, আপনি চাইলে আপনার পরিবারের বাইরের কাউকে, যেমন – আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত সহকর্মীকে নমিনি করতে পারেন। তবে এটি করার আগে ভালোভাবে চিন্তা করুন, কারণ পরে আপনার পরিবার এতে আপত্তি তুলতে পারে। তবে বিভিন্ন ব্যাংকের রুলস এন্ড রেগুলেশন অনুযায়ী, এই নিয়মগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন হতে পারে।
৬. নমিনি পরিবর্তন করা যায় কি?
অনেকেই জানেন না যে, নমিনি পরিবর্তন করা সম্ভব। যদি আপনি মনে করেন যে নমিনির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দরকার, তাহলে ব্যাংকে গিয়ে নতুন নমিনি সংযোজন বা পরিবর্তন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি ব্যাংকে আপনার স্ত্রীকে নমিনি করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে যদি স্ত্রী মারা যান বা তালাক হয়ে যায়, তাহলে আপনি চাইলে নতুন করে নমিনি নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে, আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে নতুন নমিনি সংযোজন বা পরিবর্তনের জন্য আবেদন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ নমিনি পরিবর্তন না করায় মৃত্যুর পর তার সম্পদের সঠিক বণ্টন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তাই সময়মতো নমিনি পরিবর্তন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এখন ব্যাংক একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে নমিনি নির্ধারণের পূর্বে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আলোচনা করুন। নমিনি নির্ধারণ করার আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করুন, যেন ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়। যদি সম্ভব হয়, তাহলে একাধিক নমিনি নির্ধারণ করুন এবং প্রত্যেকের জন্য সুনির্দিষ্ট শতাংশ বরাদ্দ করুন। আপনি যদি মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি যেভাবে বণ্টন হবে, সেভাবে নমিনিদের মধ্যে আনুপাতিক হারে শেয়ার দিতে চাইলে কোন দলিল লেখক বা সার্ভেয়ার/আমীন বা আইনজীবীর মাধ্যমে ফারায়েজ করিয়ে নিন এবং সেই অনুযায়ী নমিনিদের শেয়ার দিতে পারেন।
সর্বোপরি, ব্যাংক নমিনি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভুল সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বড় ধরনের পারিবারিক ও আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই নমিনি নির্ধারণ করার সময় অবশ্যই সবদিক বিবেচনা করা উচিত। সঠিক নমিনি নির্বাচন ও পরিকল্পিত বণ্টন নিশ্চিত করলে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে না এবং আপনার সঞ্চিত সম্পদ সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছাবে।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এবং বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত আরও গভীর ধারণা পেতে, এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিকের তত্ত্বাবধানে একটি অনলাইন কোর্স করতে পারেন। কোর্সে অংশগ্রহণ করতে ভিজিট করুন: academy.legalfist.com অথবা যুক্ত থাকুন আমাদের WhatsApp গ্রুপেঃ
https://chat.whatsapp.com/J0k8ORSPgLO7l08crSm9dA

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )