ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই

উত্তরাধিকার আইন

বাংলাদেশের একটি গ্রামের প্রেক্ষাপট চিন্তা করা যাক। গ্রামের মানুষ বেশ সহজ সরল এবং শান্তি প্রিয় মানুষ। এক সময় ছিল যখন মানুষ সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না, যে যার মতো করে থাকতো আর উদার মানসিকতার কারনে কারো সাথে কেউ তেমন ঝামেলা করতো না। কারন তখন মানুষ ছিল কম, জমি ছিল বেশী। কিন্তু, এখন সময় বদলেছে। সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই বানাচ্ছেন কিন্তু নতুন করে জমি আর বানাচ্ছেন না। এজন্যই দেখবেন মানুষ এখন আর বহুতল ভবন ছাড়া কেবল একতলা বাড়ি বানাচ্ছে না। তাই, আগে উদারতা দেখিয়ে এক ভাই অন্য ভাইকে যেখানে জমিজমাতে অনেক ছাড় দিতো, এখন কোন ছাড় দিতেই রাজি নন। বরং, আইনের ফাঁকফোকরে একটু বেশী সম্পত্তি কীভাবে পাওয়া যায়, সেই চিন্তায় অনেকেই মশগুল। একটা কাল্পনিক গল্প দিয়েই আজকের বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করা যাক।

আমাদের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, রফিক মিয়া ও সালাম মিয়া, দুইজনই আপন ভাই। ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বড় হওয়া, একসঙ্গে খেলাধুলা করা—তাদের বন্ধন ছিল খুবই দৃঢ়। কিন্তু, বিয়ের পর আলাদা আলাদা সংসারের বদৌলতে সময়ের পরিক্রমায় তারা আলাদা হয়ে যায়। জমিজমা ভাগ হওয়ার পর দুই ভাই আলাদাভাবে তাদের পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করে। 

রফিক মিয়ার এক ছেলে ও এক মেয়ে, তবে ছেলেটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। অন্যদিকে, সালাম মিয়ার দুই মেয়ে। জমিজমার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এতদিন তারা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু, যখন ছেলে মেয়ে গুলো বড় হতে থাকে আর দুই ভাইও বয়সের ভারে বুঝতে পারে যে, এখন সন্তানদের নামে জমির কাগজপত্র গুলো আপডেট করতে হবে, তখনি তারা ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করে। চিন্তা ভাবনা করার কারণটা অবশ্য স্পষ্টত, কারন সালাম মিয়ার কোন মেয়ে নেই আর রফিক মিয়ার ছেলে প্রতিবন্ধী। 

যথারীতি, একসময় সালাম মিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর একসময় প্রকৃতির নিয়মে স্ত্রী এবং দুই কন্যা রেখে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার স্ত্রী ও দুই কন্যা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তবে শোকের মধ্যেও সম্পত্তির প্রশ্ন সামনে চলে আসে কারন সালাম মিয়ার কোন ছেলে নেই বলে সম্পত্তি বাহিরে চলে যাবে। এখন বাড়িতে একটা কথাই চলছে, সালাম মিয়ার সম্পত্তি কীভাবে বণ্টিত হবে?

সালাম মিয়ার ভাই রফিক মিয়া ও তার সন্তানরা কি কোনো অংশ পাবেন? 

নাকি সম্পত্তি শুধুমাত্র সালাম মিয়ার স্ত্রী ও কন্যাদের মধ্যেই ভাগ হবে? 

তো চলুন আমরা দেখি মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সালাম মিয়ার সম্পত্তির বণ্টন কীভাবে হবেঃ

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, একজন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি তার জীবিত ওয়ারিশদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অংশ অনুযায়ী বণ্টিত হয়। ফারায়েজ আইনের আলোকে, সালাম মিয়ার সম্পত্তি বণ্টন যেভাবে হবেঃ 

  • ১. সালাম মিয়ার স্ত্রীর অংশ: মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে যদি কোনো ব্যক্তি মারা যান এবং তার স্ত্রী জীবিত থাকেন, তাহলে তিনি ১/৮ অংশ পাবেন। সালাম মিয়ার স্ত্রীও একইভাবে সালাম মিয়ার রেখে যাওয়ার সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবেন।
  • ২. সালাম মিয়ার কন্যাদের অংশ: মুসলিম আইন অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির শুধুমাত্র কন্যাসন্তান থাকে, তাহলে একজন হলে ১/২ (অর্ধেক) আর একাধিক হলে ২/৩ (দুই-তৃতীয়াংশ) অংশ পাবে। সালাম মিয়ার দুই মেয়ে থাকায় তারা ২/৩ অংশ পাবে এবং প্রত্যেকে ১/৩ করে সম্পত্তি পাবে।
  • ৩. অবশিষ্ট অংশ: মুসলিম আইন অনুযায়ী, সালাম মিয়ার স্ত্রী এবং কন্যাদের অংশ দেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ আসাবা লিস্টে থাকা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টিত হবে। এই ক্ষেত্রে, সালাম মিয়ার কোনো পুত্রসন্তান না থাকায়, অবশিষ্ট সম্পত্তি তার ভাই রফিক মিয়ার কাছে যাবে। এক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন, রফিক মিয়া এই সম্পত্তি পাওয়ার পর যদি মারা যান, তাহলে ওনার সকল সম্পত্তি রফিক মিয়ার ছেলে মেয়ে স্ত্রী পাবে। কিন্তু, যদি রফিক মিয়া তার ভাই সালাম মিয়ার আগেই মারা যান, তাহলে সালাম মিয়ার স্ত্রী এবং কন্যাদের অংশ দেওয়ার পর আসাবা হিসেবে যে সম্পত্তি থাকবে, সেটা পাবে হচ্ছে, রফিক মিয়ার ছেলে। তখন রফিক মিয়ার স্ত্রী বা কন্যা কোন অংশ পাবে না সালাম মিয়ার কাছ থেকে। 

আসাবা লিস্ট সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতেঃ Residuaries বা আসাবা তালিকা – Article – Legal Fist 

  • ৪. প্রতিবন্ধী সন্তানের অধিকার: মুসলিম আইনে কোনো ব্যক্তি শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী হলেও তার উত্তরাধিকারী হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। 

তবে, যদি সালাম মিয়া জীবিত থাকাকালীন সম্পত্তি তার স্ত্রী বা কন্যাদের নামে ওনার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান, তাহলে রফিক মিয়া বা তার সন্তানরা কোনো অংশ পাবেন না। কেননা, মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম হচ্ছে, যখন আপনার নামে সম্পত্তি রেখে আপনি মারা যাবেন, তখন আপনার সম্পত্তি বণ্টন হবে। কিন্তু, আপনি যদি জীবিত অবস্থায় আপনার সমস্ত সম্পত্তি কাউকে লিখে দিয়ে যান বা বিক্রি করে দিয়ে যান, তাহলে আপনার মৃত্যুর সময় যেহেতু কোন সম্পত্তি নেই, সেহেতু ফারায়েজ করারও কোন দরকার পড়ছে না। অনেকেই আছে এমন ভাইয়ের সম্পত্তি পাওয়ার লোভে বসে থাকে বা চাচার সম্পত্তির লোভে বসে থাকে, যখন ভাই বা চাচার ছেলে থাকে না। কিন্তু, ঐ ভাই বা চাচা মারা যাওয়ার আগে না ভাই/চাচার খোঁজ খবর রাখে না সম্পত্তি পাওয়ার পর এতীম ভাতিজী বা চাচাতো বোনের খোঁজ খবর রাখে। তাই, বেশীর ভাগ লোক বর্তমানে জীবিত অবস্থাতেই চেষ্টা করে, নিজের সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে যেতে, যাতে মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে স্ত্রী-কন্যাদেরকে অন্যের রোষানলে পড়তে না হয়। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন। 

মুসলিম উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতাগুলো সহজভাবে বোঝা ও প্রয়োগ করার জন্য ফারায়েজের জ্ঞান থাকা জরুরি। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এবং আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা পেতে, এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিকের তত্ত্বাবধানে একটি অনলাইন কোর্স করতে পারেন। কোর্সে অংশগ্রহণ করতে ভিজিট করুন: academy.legalfist.com অথবা যুক্ত থাকুন আমাদের WhatsApp গ্রুপেঃ https://chat.whatsapp.com/J0k8ORSPgLO7l08crSm9dA 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.