মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের হক সমান নাকি বেশি?

মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার

কিছুদিন আগে আমাদের দেশের এক হুজুর বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে নাকি সহি হাদিসের তুলনায় জাল হাদিসগুলো বেশ মুখরোচক। জাল হাদিস গুলো যত দ্রুত মানুষের মুখে মুখে ছড়ায়, সহি হাদিসগুলো সে অনুপাতে মানুষের মুখে মুখে ছড়ায় না। এটাই হচ্ছে, শয়তানের শয়তানি; সে সহি হাদিস প্রচারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে কিন্তু জাল হাদিস প্রচারে উৎসাহিত করে।
সহি এবং জাল হাদিসের মতো আইনেরও কিছু সহি আইন এবং জাল বা ভুয়া আইন রয়েছে। যে আইনগুলো সঠিক সেগুলো নিয়ে প্রচার, প্রচারণা যতটা না হয়, তারচেয়ে অনেক গুন বেশি প্রচার প্রচারণা হয়ে থাকে ভুল বা ভুয়া আইন নিয়ে। এই ভুয়া আইন প্রচারের জন্য বেশির ভাগেরই টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে নারীরা। আমাদের সমাজে নারীদেরকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করার জন্য যত প্রকারের কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে, আমার মনে হয় ভূত-পেত্নি নিয়েও এতো কুসংস্কার নেই।

নিউটনের ৩য় সূত্র অনুযায়ী, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সমাজে নারীদেরকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করার জন্য যত কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে, তার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি কুসংস্কারও প্রচলিত আছে যে, বাবার সম্পত্তিতে যেমন ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়, তেমনি ভাবে মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েরা ছেলেদের সমান পায় বা মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়।

সত্য এক বার দুই বার নয়, একশবার বললেও একই থাকে, কিন্তু মিথ্যা অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে দুইবার বললেও দুইবার বলার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে। তেমনি, মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের দ্বিমুখী দাবীর তত্ত্বটিও প্রমাণ করে যে উভয় দাবীর যেকোনো একটু ভুল বা উভয়ই অসত্য। আজকে আমরা মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার সম্বন্ধে ক্লিয়ার ধারনা নেওয়ার চেষ্টা করবো।

প্রথমত আমরা জানি যে, বাবার সম্পত্তিতে একজন ছেলে যা পাবে একজন মেয়ে তার অর্ধেক পাবে। অথবা এভাবে বলা যায় যে, একজন মেয়ে যা পাবে একজন ছেলে তার দ্বিগুণ পাবে। তাই, ছেলে মেয়ে বা ভাই বোনের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের অনুপাতটি হচ্ছে, ছেলেঃমেয়ে= ২:১ বা ভাইঃবোন= ২:১; এটি মাথায় সেট করে নিন তাহলে সামনে আর কোন অসুবিধা হবে না।
এখন কথা হচ্ছে, বাবার সম্পত্তিতে ছেলেদের অধিকার বেশি হলে মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার বেশি হবে তাই না?
একদম না। বাবার সম্পত্তিতে ছেলের অধিকার বেশি বলেই মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার বেশি হবে না। বরং, বাবার সম্পত্তি হোক আর মায়ের, ছেলের মেয়ের জন্য ঐ একই অনুপাতই প্রযোজ্য, ছেলেঃমেয়ে= ২:১।

মুসলিম আইন অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের যে হিসেবটি আমরা করে থাকি সেটি এসেছে পবিত্র আল কোরআনের সূরা নিসা থেকে। পবিত্র আল কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ নারীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার পুরুষ অভিভাবকের উপর দিয়েছে। আর নারীর পুরুষ অভিভাবক হচ্ছে বাবা, স্বামী, ভাই, ছেলে ইত্যাদি নিকট আত্মীয়। তাই, নারীকে সম্পত্তিতে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা সে অনুপাতে কম পেলেও সেটি খরচ করতে সে বাধ্য নয়, কেননা তার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার নিজের কাঁধে নয়, বরং তার পুরুষ অভিভাবকের উপর।

কিন্তু, তারপরও বাবা মায়েদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে সবসময় মেয়েদেরকে নিয়ে। বাবা মা তাদের লক্ষ্মী মেয়েটিকে নিয়ে যেসব দুশ্চিন্তা করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,

  • মেয়েরা ঠিক মতো স্বামীর সংসার করতে পারবে কিনা, যদি স্বামীর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়?
  • স্বামীর অকাল মৃত্যু হলে বিধবা হয়ে মেয়ে কি করবে?
  • স্বামীর সাথে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে মেয়ের কি হবে?
  • বাবা মায়ের মৃত্যুর পর ছেলে বা ভাইয়েরা মেয়েদেরকে ঠিক মতো দেখাশোনা বা আপ্যায়ন করবে তো?

নানাবিধ চিন্তায় অনেকে বাবা মায়েরাই তাদের জীবদ্দশায় তাদের ছেলে মেয়ের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটি আইনত বাধ্যতামূলক নয়, কেবলই ওনাদের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা। একজন ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার সম্পত্তি যাকে খুশী তার কাছে যেমন বিক্রি করতে পারেন, তেমনি ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাকে খুশী তাকে যতটুকু খুশী ততটুকু দিয়ে যেতে পারেন, এখানে আইনত কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত হবেন না।

অনেক সময় দেখা যায় যে, ছেলের পড়াশোনা, ব্যবসা, চাকরী বা বিদেশ পাঠানোর মত অনেক ধরনের কাজে বাবা মা বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন, যা কিনা মেয়ের ক্ষেত্রে হয়ত করতে হয় না। উল্টো চিত্রও আছে, ছেলে সারাজীবন স্কলারশিপে পড়াশোনা করে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করছে, সেখানে মেয়েকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর আবার বিয়ে দিতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। তাই, ছেলে মেয়ের পিছনে কত টাকা খরচ করা হয়েছে সেটি কেবল বাবা মা নিজেরাই জানেন; এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, পরিবার থেকে পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই বাবা মা নিজেদের হিসেবে নিজেদের সম্পত্তি নিজস্ব বিবেক বিবেচনা খরচ করে বণ্টন করে যেতে পারেন।

যার ফলশ্রুতিতে অনেক বাবা মায়েরাই এখন মেয়েদেরকে ছেলেদের সমান সম্পত্তি দিয়ে হেবা দলিল করে যাচ্ছে বা মেয়েকে সামান্য কিছু সম্পত্তি আলাদা ভাবে অছিয়ত বা উইল করে যাচ্ছে। আবার অনেকেই সমান না দিলেও মেয়েকে ৪০% আর ছেলেকে ৬০% সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছে বা বণ্টন করে যাচ্ছে। এটা একান্ত বাবা মায়েদের ইচ্ছে, আইনত কোন বাঁধা নেই, বাকিটা আল্লাহ্‌ ভালো জানেন।
কিন্তু, বাবা মা যদি তাদের সম্পত্তি নিজেরা বণ্টন করে না যান বা হেবা বা অছিয়ত বা উইল করে না যান, তবে বাবা মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই তাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকার হিসেবে সন্তানদের মধ্যে ছেলেঃমেয়ে= ২:১ অনুপাতে বণ্টন করা হবে। এই আইনের কোন নড়চড় নেই; আশা করি আর গুজব বা কুসংস্কারে কান দিবেন না।

 

কুসংস্কারের উৎপত্তি নিয়ে কিছু শুনবেন?
আচ্ছা, মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েরা ছেলেদের সমান পায় বা মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাওয়া নিয়ে যে ভুয়া আইন বা কুসংস্কারটি প্রচলিত আছে, সেটির উৎপত্তি হয়েছে মূলত আজকাল প্রায় পড়াশোনা, চাকরী থেকে শুরু করে সব সেক্টরে মেয়েদের অধিকার সমান বলে সরকার বিভিন্ন নিয়ম করছেন বা ছেলেদের মত মেয়েদেরকেও একই সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। এই পদক্ষেপগুলো থেকেই অনেকের মনে এই ভুল ধারণাটি জন্ম নিচ্ছে যে, তাহলে সম্পত্তিতেও মেয়েদের অধিকার ছেলেদের সমান হবে; যা আদৌতে ভুল। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই