মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে মায়ের অধিকার

সন্তানের সম্পত্তিতে মায়ের অধিকার

হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলেছিলেন, পৃথিবীতে মা হচ্ছেন একমাত্র ব্যাংক যেখানে আমরা আমাদের সকল দুঃখ কষ্ট জমা রাখি, যার বিনিময়ে আমরা পেয়ে থাকি বিনা সুদে অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই মা জীবিত অবস্থায়, সেই মাকে ছেড়ে, সেই ভালোবাসাটুকু ছেড়ে আমাদের অনেক সময় দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। মা জীবিত অবস্থায় সন্তানের মৃত্যু, মা কিভাবে হজম করে তা কেবল আল্লাহ্‌ ভালো জানেন আর মা জানেন। যে সন্তানকে দীর্ঘ দশ মাস গর্ভে ধারণ করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পৃথিবীতে আনতে হয়েছে, সেই সন্তানকেই আবার শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় কত কষ্টে লালন পালন করে এতো বড় করার পর যখন ঐ সন্তান মাকে দুনিয়াতে রেখেই ইহকাল ত্যাগ করে, তখন ঐ মা না জানি কেমন করে এই শোক সামাল দেন, আল্লাহ্‌ ভালো জানেন। আল্লাহ্‌ মায়েদেরকে এমন শোক থেকে নিরাপদ রাখুন, এটাই সকল মায়েদের জন্য দোয়া রইল। তারপরও যদি ঘটনাচক্রে কোন সন্তান তার মায়ের আগেই মৃত্যুবরণ করে এবং তার নিজের নামে সম্পত্তি থেকে থাকে, তাহলে উত্তরাধিকার সূত্র অনুসারে মৃত ছেলে বা মেয়ের সম্পত্তি থেকে মা অংশ পাবেন। এই ক্ষেত্রে মা ৩ অবস্থায় ভাগ পেয়ে থাকেন।

প্রথমত, যখন মৃত সন্তানের কোন সন্তান থাকবে বা মৃত সন্তানের পুত্রের সন্তান থাকবে (অর্থাৎ ওনার নাতির কোন সন্তান থাকবে) বা দুই বা ততোধিক ভাই বোন থাকবে (অর্থাৎ ওনার মৃত ছেলে বা মেয়ের পাশাপাশি আরও দুই বা ততোধিক সন্তান থাকবে), তখন মা হিসেবে তিনি সন্তানের রেখে যাওয়ার সম্পত্তির ৬ (ছয়) ভাগের ১ (এক) ভাগ পাবেন। শতকরা হিসেব করলে যা দাঁড়ায়, ১৬.৬৬%।

দ্বিতীয়ত, যদি মৃত সন্তানের কোন সন্তান না থাকে বা মৃত সন্তানের ছেলের কোন সন্তান না থাকে (অর্থাৎ নাতির কোন সন্তান থাকবে না) বা মৃত সন্তানের ভাই বোন একের অধিক থাকবে না (অর্থাৎ ওনার এই মৃত সন্তান ব্যতীত আর একটি মাত্র সন্তান থাকবে); তখন তিনি মৃত সন্তানের রেখে যাওয়ার সম্পত্তির ৩ (তিন) ভাগের ১ (ভাগ) উত্তরাধিকার সূত্রে পাবেন। শতকরা হিসেব করলে যা দাঁড়ায়, ৩৩.৩৩%।

তৃতীয়ত, মৃত সন্তানের যখন পিতা থাকবে (অর্থাৎ ওনার স্বামী থাকবে) এবং মৃত সন্তানের জীবনসঙ্গিনী থাকবে (ছেলে হলে স্ত্রী, মেয়ে হলে স্বামী), তখন উক্ত জীবনসঙ্গিনীকে দেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তির ৩ (তিন) ভাগের ১ (ভাগ) উত্তরাধিকার সূত্রে মা পাবেন। এই ক্ষেত্রে আমরা জানি সন্তান ছেলে হলে স্ত্রী নিঃসন্তানের বেলায় ৪ (চার) ভাগের ১ ভাগ আর সন্তান থাকলে ৮ (আট) ভাগের ১ ভাগ। আবার সন্তান মেয়ে হলে স্বামী নিঃসন্তানের বেলায় অর্ধেক আর সন্তান থাকলে ৪ (চার) ভাগের ১ ভাগ। তাহলে উক্ত মৃত সন্তানের স্বামী বা স্ত্রীকে দেওয়ার পর যে অবশিষ্ট সম্পত্তি থাকবে তার ৩ (তিন) ভাগের ১ (ভাগ) উত্তরাধিকার সূত্রে মা পাবেন। এই হল মায়ের ৩ পরিস্থিতিতে সম্পত্তি পাওয়ার হিসেব।



 

এবার আসা যাক, দাদী নানীর সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে। দাদী নানীর সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়টি মায়ের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, তাই ভিন্ন আর্টিকেল না লিখে একসাথে লিখে ফেললাম যাতে বুঝতে সহজতর হয়। দাদা যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে হলে বাবাকে মৃত হতে হয়, তেমনি দাদীকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে হলে মাকে মৃত হতে হবে। মৃত ব্যক্তির যদি মা জীবিত না থাকে কিন্তু দাদী জীবিত থাকেন, তাহলে দাদী মৃত নাতির সম্পত্তি থেকে ৬ (ছয়) ভাগের ১ (ভাগ) উত্তরাধিকার সূত্রে পাবেন।

তবে, মজার বিষয় হচ্ছে যদি মৃত ব্যক্তির বাবা জীবিত থাকে, তাহলে বাবা তো সম্পত্তি পাবে, তখন আর দাদী সম্পত্তি পাবে না। এখানেই হচ্ছে মুসলিম উত্তরাধিকারের সৌন্দর্য। বাবা জীবিত থাকলে দাদীকে আলাদা করে কেন সম্পত্তি দিতে হবে, বাবাই তো দাদীর দেখভাল করতে পারবেন। এইজন্যই নিকটবর্তী আত্মীয় দূরবর্তী আত্মীয়কে উত্তরাধিকার হিসেবে বঞ্চিত করে থাকে। তাহলে বলা চলে, বাবা মা দুইজনই দাদীকে বঞ্চিত করছে। এই ক্ষেত্রে যদি নানী জীবিত থাকে তাহলে বাবা থাকার দরুন, দাদী না পেয়ে নানী মৃত নাতির সম্পত্তি থেকে ৬ (ছয়) ভাগের ১ (ভাগ) উত্তরাধিকার সূত্রে পাবেন। এখানেও আবার শর্ত হচ্ছে, মা যদি জীবিত থাকে তাহলে নানী সম্পত্তি পাবে না। কেননা, মা নানীকে দেখভাল করতে পারবে। অর্থাৎ, বাবা জীবিত থাকলে দাদী পাবে না আর মা জীবিত থাকলে নানী সম্পত্তি পাবে না। উল্লেখ্য, মা, দাদী, নানী কেউই আসাবা হিসেবে কোন সম্পত্তি পাবে না। শুধুমাত্র শেয়ারার হিসেবে যা পাবেন, এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।

এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে থাকেন যে, সৎ মা যদি থেকে থাকেন তাহলে তিনি কি কোন সম্পত্তি পাবেন কিনা, আমরা যেমন দেখেছিলাম যে একাধিক স্ত্রী থাকলে তারা প্রত্যেকে সম্পত্তি পেয়ে থাকে, তাহলে বাবার যদি একাধিক স্ত্রী থেকে তাহলে তো মৃত ব্যক্তির একাধিক মা, সে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির প্রত্যেক মা কি উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পাবে?- জি না। শুধুমাত্র নিজের আপন মা তথা বায়োলজিক্যাল মা’ই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে। ঠিক তেমনি বাবাও যদি একাধিক হয়, শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল বাবাই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবেন। বলাবাহুল্য, একাধিক দাদী নানীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

 

কিছুদিন আগে আমার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় সম্পর্কে ছোট ভাই হয়, সরকারী চাকরিজীবী, ছুটিতে বাড়ি গিয়ে বন্ধুর সাথে মোটর সাইকেলে রাতে বাড়িতে ফেরার পথে ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে মারা গিয়েছে। উঠতি বয়সী এই ছেলে যখন মারা গেলো, তখন মা তার সন্তানের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অংশ পাবে পাশাপাশি সরকারী চাকরীর পেনশনের দাবীদার হবেন; কিন্তু মা কি কখনো ঐ সন্তানের অভাব সন্তানের সম্পত্তি দিয়ে মুছতে পারবেন?

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই