বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের জন্ম, সে যেভাবে সম্পত্তি পেতে পারে

উত্তরাধিকার আইন

শীতের এক সকালে, নোয়াখালী জেলার কেশার পাড় নামক গ্রামের একটি ছোট্ট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সালেহা বেগম আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার স্বামী সেলিম সাহেবের মৃত্যুর পর জীবনটা যেন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। সালেহা বেগম ছোট একটি সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন। তার দুই সন্তান, মেয়ে মুন্নি এবং ছেলে মান্না, এখন তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন।

সেলিম সাহেব ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি খুব মিতব্যয়ী ছিলেন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে কাজ করতেন। তবে তার জীবনের শেষ দিকে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার সকল সম্পত্তি তার প্রিয় স্ত্রী সালেহা বেগম এবং মেয়ে মুন্নির নামে লিখে দেন। তখন তার ছোট ছেলে মান্না পৃথিবীতে আসেনি। তাই মান্নার সম্পত্তিতে অধিকারের কথা ভাবার সুযোগও পাননি তিনি।

 

সালেহা বেগম এবং মুন্নি এই সম্পত্তি নিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু, সেলিম সাহেবের মৃত্যুর পরপরই যখন মান্না জন্ম নিল, সবার জীবন বদলে গেল। মান্না যখন একটু বড় হলো, সে শুনল তার বাবার সব সম্পত্তি মা এবং বোনের নামে। বাবার মৃত্যুর পর যেখানে সকল সন্তান তাদের বাবার সম্পত্তিতে অংশীদার হয়, সেখানে মান্নার বাবার মৃত্যুর পর তো তার বাবার নামে কোন সম্পত্তিই অবশিষ্ট নেই। এখন মান্নার তাহলে কি হবে?  

মান্নার বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হলে আমাদের মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে জানতে হবে। ইসলামিক শরিয়াহ আইনের অধীনে একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি কীভাবে বিতরণ হবে তা পবিত্র আল কোরআনের সূরা নিসাতে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। 

 

মান্নার জন্মের আগেই তার বাবা সেলিম সাহেব তার সকল সম্পত্তি তার স্ত্রী এবং মেয়ের নামে লিখে দেন। এই সম্পত্তি লিখে দেওয়া একটি গিফট (হেবা) হিসেবে বিবেচিত হয়। হেবা এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একজন ব্যক্তি তার সম্পত্তির মালিকানা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করেন। যেহেতু সম্পত্তি সেলিম সাহেব তার জীবিত অবস্থায় দিয়ে গেছেন, তাই সেলিম সাহেবের মৃত্যুর পর ওই নামে যেহেতু কোন সম্পত্তি নেই, সেহেতু উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টনেরও প্রয়োজন নেই। সুতরাং, বাবার কাছ থেকে মান্না কোন সম্পত্তি পাবে না।

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, একটি পরিবারে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন হয়। যদি সালেহা বেগম মারা যান এবং তার নামের সম্পত্তি থেকে যায়, তখন মান্না সেই সম্পত্তির উপর অধিকার দাবি করতে পারবেন। এখানে মুসলিম আইন অনুযায়ী, যদি মেয়ের সাথে পুত্রও থাকে, তাহলে পুত্র দুই তৃতীয়াংশ এবং কন্যা এক তৃতীয়াংশ পাবে। অর্থাৎ, মান্না এবং মুন্নি ২:১ অনুপাতে সম্পত্তি পাবে।

মান্না কিন্তু মুন্নির কাছ থেকেও সম্পত্তি পেতে পারে। যদি মুন্নি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যায়, তাহলে ভাই হিসেবে মান্না মুন্নির পুরো সম্পত্তিই পাবে, যদি মা জীবিত না থাকে। মা জীবিত থাকলে মাকে মায়ের অংশ দেওয়ার পর অবশিষ্ট পুরো অংশই মান্না পাবে। শুধু অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলেই যে পাবে, তা কিন্তু নয়। মুন্নি যদি বিবাহের পর ছেলে সন্তানের মা না হতে পারে, তাহলেও কিন্তু স্বামী এবং কন্যা সন্তানদেরকে সম্পত্তি দেওয়ার পর একটা অংশ অবশিষ্ট থাকবে, যেটা জীবিত থাকলে মান্না পাবে। তবে, মুন্নির যদি নিজের সন্তান থাকে এবং সেই সন্তানরা ছেলে হয়, তবে মান্না তার বোনের অংশের কোনো অংশ পাবে না। 

 

তাহলে উপরের আলোচনাকে যদি আমরা সংক্ষিপ্ত করি তাহলে এই দাঁড়ায় যে, মান্না তার বাবার সম্পত্তি বণ্টনের সময় সে বাদ পড়েছে, কারণ তার জন্মের আগেই তার বাবা সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যু পর, বাবার কোনো সম্পত্তি অবশিষ্ট ছিল না, তাই সে কোনো অংশ পাবে না। তবে, তার মায়ের মৃত্যুর পর যদি তার মা জীবনের শেষ সময়ে কোনো সম্পত্তি রেখে যান, তখন সে তার অংশ দাবি করতে পারবে। যদি তার বোন মুন্নি বেঁচে থাকে, তবে তার সাথে ২:১ অনুপাতে সম্পত্তি ভাগ হবে। আর যদি মুন্নি মারা যায় এবং তার কোনো পুত্র সন্তান থাকে, তবে সেই সন্তানরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, মান্না নয়।

তবে, মান্নার মা সালেহা বেগম যদি পুনরায় অন্যত্র বিবাহ করেন এবং সেখানে তার সন্তান হয়, তাহলে তখন মান্নার সম্পত্তির পরিমাণ আরও কমে যাবে। কেননা, তখন তাকে তার আপন বোন মুন্নির পাশাপাশি বৈপিত্রেয় ভাইবোনদের সাথেও সম্পত্তি শেয়ার করতে হবে। তাছাড়া, ধরুন সালেহা বেগম সেলিম সাহেবের মৃত্যুর পর জসিম সাহেবকে বিবাহ করেন এবং সালেহা বেগমের মৃত্যুকালে জসিম সাহেব জীবিত থাকেন, তখন জসিম সাহেবও স্বামী হিসেবে ১/৪ অংশ সম্পত্তি পাবেন সালেহা বেগমের কাছ থেকে। এতে মান্নার জন্য সম্পত্তির অংশ আরও সংকুচিত হবে। কিন্তু, জসিম সাহেবের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মান্না কোন অংশ পাবে না। কেননা, সৎ বাবা কিংবা সৎ মায়ের কাছ থেকে সৎ ছেলে মেয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পায় না। 

 

মজার বিষয় হচ্ছে, যদি সালেহা বেগমের পূর্বেই জসিম সাহেব মৃত্যুবরণ করেন আর জসিম সাহেবের নামে সম্পত্তি থেকে থাকে, তাহলে সেই সম্পত্তি সালেহা বেগমের কাছে আসবে ১/৪ অংশ বা ১/৮ অংশ। যদি জসিম সাহেবের সন্তান থাকে তাহলে সালেহা পাবে ১/৮ অংশ আর সন্তান না থাকলে ১/৪ অংশ। তখন ঐ অংশটুকু একান্তই সালেহা বেগমের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন যদি সালেহা বেগম মৃত্যুবরণ করেন, তখন কিন্তু মান্না তার মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে, যা কিনা তার মা তার সৎ বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। তার মানে হচ্ছে, মান্না সরাসরি তার সৎ বাবার কাছ থেকে সম্পত্তি পাবে না, তবে তার মায়ের মাধ্যমে পেতে পারে। কেননা, উত্তরাধিকার সূত্রে কারো কাছে কোন সম্পত্তি গেলে সেটা একান্ত গ্রহীতার সম্পত্তি হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.