লা ওয়ারিশ

কেন লা-ওয়ারিশ প্রথা বাতিল করা হল?

উত্তরাধিকার আইন

দাদা জীবিত অবস্থায় যদি বাবা মারা যায় সে ক্ষেত্রে আপনার আমার সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে কিনা সেই নিয়েই আমরা আজকে আলোচনা করবো। আপনার দাদা জীবিত অবস্থায় যদি আপনার বাবা মৃত্যুবরণ করে সে ক্ষেত্রে আপনার দাদার যে সম্পত্তি রয়েছে, যেখানে আপনার বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার কথা কিন্তু আপনার বাবার মৃত্যুতে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা জানি, উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সম্পত্তি না থাকলে বাবার কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যায় না আবার মৃত ওয়ারিশ কোন সম্পত্তি পায় না। তাহলে বাবা যেহেতু দাদার আগে মারা গেছে, সেহেতু বাবা হচ্ছে দাদার মৃত ওয়ারিশ, বাবা সম্পত্তি পাবে না। বাবা যদি সম্পত্তি পাবে না, তাহলে আমি আপনি বাবার কাছ থেকে কিছুই পাবেন না।

 

এখন সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন দাদা, দাদার মৃত্যুতে দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে আপনার অধিকার হয়েছে কিনা, ঠিক তেমনি দাদী বা নানা বা নানীর জীবদ্দশায় বাবা বা মায়ের মৃত্যুতেও আপনার দাদা, দাদী, নানা, নানীর সম্পত্তিতে আপনার অধিকার রয়েছে কিনা, তাই হচ্ছে আজকের আর্টিকেলের বিষয়বস্তু। উল্লেখ্য, বারংবার দাদা, দাদী, নানা, নানী উল্লেখ না করে শুধু দাদা দিয়েই আর্টিকেলটা লিখছি। তবে পাঠক দাদার স্থলে দাদী, নানা, নানী সব কয়টাই রিলেট করতে পারবেন এবং একই নীতিই অবলম্বন করা হবে।
আমরা পূর্বে অনেকবার আলোচনা করেছি যে, মৃত ওয়ারিশ কখনো উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায় না। যার ফলে দাদা জীবিত অবস্থায় বাবা মারা গেলে বাবা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন এবং বাবা যেহেতু বঞ্চিত সেহেতু নাতি-নাতনিরাও বঞ্চিত; এটাকে বলা হতো লা-ওয়ারিশ প্রথা। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) উনার বাবা আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পরে তিনি তার মায়ের কাছে থাকলেও প্রকৃত অর্থে উনি তাঁর দাদার জিম্মায় ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর তিনি চাচার জিম্মায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাবার মৃত্যুর পর চাচারা মৃত ভাইয়ের সন্তান অর্থাৎ এতিম ভাতিজা-ভাতিজীদেরকে ভরণপোষণ তো দূরে থাক, ঐ বাড়ীতে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে চলে সাথে অনেক ধরনের অমানুষিক নির্যাতন। তাছাড়া আরও অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অবশেষে ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের আমলে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় Muslim Family Law Ordinance বা মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৪ ধারায়, লা-ওয়ারিশ প্রথাকে বাতিল করা হয়। যার ফলে ১৯৬১ সালের পর থেকে কোন ব্যক্তির দাদা জীবিত অবস্থায় যদি বাবা মারা যায়, সেক্ষেত্রে বাবা জীবিত থাকলে যতটুকু সম্পত্তি পেতো, উক্ত এতিম নাতি-নাতনি ঠিক ততটুকু সম্পত্তি পাবে। এতিম নাতি-নাতনি এমন ভাবে সম্পত্তি পাবে যাতে মনে হবে যে তাদের বাবা-মা মারা যায় নি; বাবা মা জীবিত থাকলে যে অংশ পেতো, তা সরাসরি তাদের কাছে চলে যাবে।



 

আইনটি পাশ করার পরে আবার কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এটা সাধারণত প্রত্যেকটা আইন পাস হওয়ার পরেই এক্সিস্টিং যে কেস স্টাডি গুলো রয়েছে সেগুলো কিছু সমস্যা তৈরি করে। যেমন, ১৯৬১ সালের আগের যদি এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকে অর্থাৎ ‘৬১ সালের আগে কারো বাবা মারা যায় দাদা জীবিত অবস্থায় সেক্ষেত্রে সে কি এই আইনের আওতায় সুযোগ পাবে কিনা। সাধারণত কোন আইন পাস হলে আইন পাস হওয়ার সময়ই বলে দেয় যে, কবে থেকে কার্যকর হবে; সেটা কি আরও অনেক আগেকার সময়ে কার্যকর হবে ধরে নেওয়া হবে নাকি বর্তমান সময় থেকে কার্যকর হবে নাকি ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময়ের পরে কার্যকর হবে। সেই হিসেবে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ জারির পরপরই কার্যকর হয়, এখন যদি এই ধরনের কোন ঘটনা আইন পাশের পূর্বেই ঘটে থাকে, তাহলে নাতি-নাতনি এই আইনের আওতায় সুযোগ পাবে না। তবে যদি বাবা-মা ১৯৬১ সালের আগে মারা যায় কিন্তু দাদা মারা গিয়েছেন ১৯৬১ সালে আইন কার্যকরের পরে, সেক্ষেত্রে এতিম নাতি-নাতনি এই আইনের সুযোগ সুবিধা পাবে। কেননা আমরা জানি কোন ব্যক্তি যখন মারা যায় ঠিক তখনই তার সাকসেশন চালু হয় বা খুলে।

 

লাওয়ারিশ প্রথা বাতিল হওয়াটা সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টনের পুরো রীতির দুটো দিক থেকে ব্যতিক্রম নীতি সৃষ্টি করেছে। যদিও এই নীতি অন্য কোথাও প্রয়োগযোগ্য নয়, এতিম নাতি-নাতনিদের বেলাতেই শুধু এটা প্রযোজ্য। প্রথম ব্যতিক্রম হচ্ছে, আমরা পুরো উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টনের প্রকৃতিতে দেখেছি যে মৃত ওয়ারিশ কখনো সম্পত্তিতে অংশীদার হয় না কিন্তু এখানে বাবা-মায়েরা মৃত ছিলেন, তারা ঠিকই সম্পত্তিতে অংশীদার হলেন, যদিও তারা ভোগ করতে পারছে না, তাদের সন্তানরা ভোগ করছেন, কিন্তু মৃত হওয়ার সত্ত্বেও টেকনিক্যালি সম্পত্তিতে ভাগ পেয়েছেন। দ্বিতীয় আরেকটি ব্যতিক্রম হচ্ছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কখনো দুইটি ডিগ্রী একসাথে সম্পত্তি পায় না, যেমন ভাই থাকলে ভাইয়ের ছেলে সম্পত্তি পাবে না, পিতা থাকলে দাদা, দাদী সম্পত্তি পাবে না, মা থাকলে নানী পাবে না। কিন্তু এখানে একই সাথে দুটো ডিগ্রী সম্পত্তি পাচ্ছে। অর্থাৎ ছেলেও সম্পত্তি পাচ্ছে আবার মৃত ছেলের ছেলেও সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাচ্ছে। চাচা ভাতিজা দু’জনে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি পাচ্ছে যা কিনা সাধারণ নিয়ম অনুসারে পাওয়ার কথা না। এই হল, লা-ওয়ারিশ প্রথা এবং এর বাতিল হওয়ার ইতিহাস। যদিও এই আইনটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, এটা এতো বছরের পুরনো নিয়ম বা ইসলামিক নিয়মকে সংশোধন করা হয়েছে বলে অনেকেই এটাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করে থাকেন। তবে চাচারা, মামারা এতীমদেরকে যদি পুরো দেখভাল করতো তাহলে হয়ত এই আইনটি সংশোধনের দরকার ছিল না। যাই হোক, আপনার কাছে কি মনে হয় এই আইনটি উপকারী নাকি অপকারী তা আমাদেরকে ইমেইল করে জানাতে পারেন আর বাস্তব কোন কেস স্টাডি থাকলে তা যানাতেও ভুলবেন না।

ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.