ত্যাজ্য সন্তানের উত্তরাধিকার

ত্যাজ্য সন্তান

মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে বসবাস করতে হলে মানুষকে একে অন্যের সাথে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে থাকতে হয়। আরো ছোট পরিসরে যদি চিন্তা করি, সেই ক্ষেত্রে মানুষ পরিবার গঠন করার মাধ্যমে পৃথিবীতে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে চায়। সামাজিক জীব হোক আর পারিবারিক, মানুষকে মূলত একে অন্যের সাথে সম্পর্ক তৈরির ভিত্তিতেই সামনে এগিয়ে চলতে হয়। সামান্য এক কিলোমিটার দূরে যেতে হলেও আমাদেরকে একটি অটো রিক্সাতে উঠতে হয়, ওই অটো চালকের সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি তাকে ভাড়া দিব তার বিনিময়ে সে আমাকে ওই নির্দিষ্ট পথ পার করে দিবে; এই হচ্ছে আমাদের মাঝে একটি বিনিময় সম্পর্ক। বাবা-মা আমাদেরকে জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন আবার বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হবেন, তখন আমরা তাদেরকে দেখভাল করব; এই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। সমাজের যে ধরনের সম্পর্ক গুলো রয়েছে এই সম্পর্ক গুলো সাধারণত দুই ধরনের। এই দুই ধরনের পার্টিশন আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে; আমি এই বিভক্তি করছি শুধুমাত্র এই আর্টিকেলটি বোঝানোর স্বার্থে। আমি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে যে দুই ভাগে বিভক্ত করছি, তার প্রথমেই রাখছি, আল্লাহ প্রদত্ত সম্পর্ককে, যেটা আমরা ইচ্ছা করি আর নাই করি, আল্লাহ্‌ যেভাবে চাইবেন সেইভাবেই হবে। আর দ্বিতীয় আরেকটি সম্পর্ক হচ্ছে, যেটি আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে, আমাদের পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে।

প্রথমে আমরা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পর্কের উপর আলোচনা করবো। আমাদের বাবা-মা কেমন হবে সেটা কিন্তু কখনই আমাদের হাতে ছিল না কিংবা আমি নিজে ছেলে হবো না মেয়ে হবো, আমার উচ্চতা কতটুকু হবে, গায়ের রং কেমন হবে, এগুলোর কোনোটা না জেনেই আমাকে জন্ম দিয়েছে আমার বাবা-মা, তাদের পছন্দ পছন্দের উপর নির্ভর করে আমার জন্ম হয়নি, আপনার জন্ম হয় নি, ঠিক ভবিষ্যতেও আমাদের সন্তান কেমন হবে সেটা কোন মতে আমাদের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, কিন্তু আপনি কাকে বিবাহ করবেন, কার সাথে আপনি বন্ধুত্ব করবেন, সেটি কিন্তু অনেকাংশে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, আপনি আমার এই আর্টিকেলটি পড়বেন না, অন্য কোন ওয়েবসাইটে গিয়ে আর একটি আর্টিকেল পড়বেন, এটা আপনার উপর নির্ভর করে, আমিও পরবর্তী আর্টিকেল কাদের নিয়ে লিখব, সেটা আমার উপরই নির্ভর করছে, যদিও আমরা জানি প্রত্যেকটা জিনিসই আল্লাহর পরিকল্পনা মাফিক বা ওনার হুকুমে চলে তারপরও কিছু কিছু বিষয় উনি আমাদের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এখন যে বিষয়গুলো আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণে, আমাদের ইচ্ছামত আমরা করছি সেই সম্পর্ক গুলোকে আমি আল্লাহ প্রদত্ত সম্পর্ক চাইতে কিছুটা আলাদা করে দেখছি। এর কারণ হচ্ছে মুসলিম আইন অনুসারে বাবা-ছেলে, মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে, মা-মেয়ে, বাবা-মায়ের সাথে তার সন্তানের, ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক এগুলো কোনভাবে ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু আপনি চাইলে আপনার ভালোবাসার মানুষকে বিবাহ করার পরও আপনার ঐ বউকে চাইলেই নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে তালাক দিতে পারেন বা বিবাহ বিচ্ছিন্ন করতে পারেন। আপনার যে বেস্ট ফ্রেন্ড, জানে জিগার, যে বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল মনে করেন, তাদের সাথেও সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারেন বা তারা আপনার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারে কিন্তু আপনি কখনই চাইলে আপনার বাবা, মা, ভাই, বোনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। মেডিকেলের ভাষায় এগুলোকে আমরা বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক বলে থাকি। এই লম্বা লেকচার দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, আমরা অনেক সময় নাটক-সিনেমা উপন্যাসের মধ্যে ত্যাজ্য পুত্র বা ত্যাজ্য কন্যা এই শব্দগুলো শুনে থাকি। গল্প-উপন্যাসে মানুষকে আবেগপ্রবণ করার জন্য, মানুষকে আকৃষ্ট করে দেখানোর জন্য অনেক কিছুই দেখানো হয়ে থাকে। তাছাড়া গল্প সিনেমায় এক দেশের কালচার আরেক দেশে দেখানো হয়ে থাকে, এক ধর্মের কালচার আরেক ধর্মে দেখানো হয়ে থাকে। এই ত্যাজ্য সন্তানের কালচার সাধারণত হিন্দু ধর্মে প্রচলিত রয়েছে, কিন্তু মুসলিম আইন অনুসারে এটা কখনো সম্ভব নয়।



আপনার সাথে আপনার সন্তানের খুবই খারাপ সম্পর্ক হতে পারে, আপনার সন্তান আপনার অবাধ্য হতে পারে, কিন্তু এর জন্য কোন মতেই আপনার সন্তান আপনার কাছ থেকে সম্পর্কের দিক থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আপনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেন, তার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবেন, তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য সকল সম্পত্তি অন্যান্য সন্তানদেরকে দিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু আপনার সাথে আপনার সন্তানের যে বায়োলজিক্যাল যে সম্পর্ক রয়েছে, সেটি কখনোই আপনার সন্তানের সাথে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না। এখন অনেক সময় দেখা যায় যে, অনেক সন্তান হওয়ার কারণে কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে তাদের পছন্দে বিবাহ করে ফেলে সাধারণত অনেক সময় দেখা যায় যে, আমাদের দেশে তাদেরকে বঞ্চিত করে দেওয়া হয়, ফ্যামিলি থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাদেরকে ত্যাজ্য বলে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই করার কারণে তারা কখনও তাদের বাবা-মার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। পূর্বেই বলেছি বাবা-মা যদি একটা সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য তার জীবদ্দশায় পুরো সম্পত্তি অন্য সন্তানদের বিক্রি বা দান করে দিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে ঐ সন্তান উক্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু শুধুমাত্র সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পরে বাবা-মা তাদের সম্পত্তি অন্য সন্তানদের মধ্যে যদি বণ্টন করে না দিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে ওই ঐ সন্তান অবশ্য তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে, তাকে কোনভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

 

তবে একজন সন্তান কখন তার বাবা মায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে, সেই বিষয়ে আপনার মনে যদি প্রশ্ন আসে, তাহলে বলবো এক্ষেত্রে মোটামুটি দুটো বিষয় আপনাকে সবসময় মনে রাখতে হবে।

  • যে কোন সন্তান যদি ধর্মান্তরিত হয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে সে তার বাবা-মার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পাবে না এবং
  • ওই সন্তান যদি তার বাবা কিংবা মা বা যে কোন ব্যক্তিকে যার কাছ থেকে সম্পত্তি পাওয়ার জন্য অধিকারী ব্যক্তিকে খুন করে থাকে এবং সেটা প্রমাণিত হয় তাহলে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি পাবে না। 

অন্যথায় বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক রয়েছে, তা সম্পূর্ণ বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক; যা কখনোই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সুতরাং, কথিত ত্যাজ্য সন্তান বাবা-মার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার জন্য বৈধ উত্তরাধিকার।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন, তারপরও কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে আমাদেরকে ই-মেইল (tanbir@legalfist.com) করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই