নানার বাড়ির হক সরাসরি নিজেদের নামে আনার প্রক্রিয়া

নানা বাড়ি সম্পত্তি

সালাম সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে, ছেলে কালাম আর মেয়ে হচ্ছে সালমা। উভয়কে বিয়ে-শাদী দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার এক যুগ পর সালাম সাহেব মৃত্যুবরণ করেন, তারও এক যুগ পর সালাম সাহেবের স্ত্রী পরলোক গমন করেন। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর সালমা বেগম নিজ বাবার বাড়ি যা বর্তমানে ভাইয়ের বাড়ি, যাওয়া আসা অপেক্ষাকৃত কমিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের দেশের মা-বোনরা যতদিন পর্যন্ত বাবা-মা জীবিত থাকে ততদিন পর্যন্ত বাবার বাড়িতে যে আদর সমাদর পেয়ে থাকেন, বাবা মায়ের মৃত্যুর পর সেই তুলনায় আর পেয়ে থাকেন না। কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভাইয়েরা তাদের বোনদের প্রতি ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ রাখে বলে বোনরা বাবা মায়ের মৃত্যুর পরও ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া আসা অব্যাহত রাখেন এবং বোনের ছেলে মেয়েরা তখন নানার বাড়ির পরিবর্তে মামার বাড়িতে ছুটি কাটাতে যেতে পছন্দ করেন।

কিন্তু সে সৌভাগ্য সবার ক্ষেত্রে হয়ে উঠে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাবা মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে ভাইদের আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। তখন বোনদের সাথে ব্যবহার আর আগের মত থাকে না, বোনরাও তখন ভাইদের আচরণের পরিবর্তন দেখে বাবার বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দেয়।
ভাইয়েরা বোনদের সাথে এ ধরনের আচরণ করে থাকে সাধারণত দুই কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে, অভ্যাসগত বা স্বভাবগত। কিছু মানুষ থাকেই এমন যে তাদের কাছে নিজ পরিবারের বাহিরে আদর-আপ্যায়ন, ভালবাসার কোন দাম নেই। স্ত্রী-সন্তান আর শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে তারা; ভাই বোনদের মূল্য তাদের কাছে নেই বললেই চলে।
আরেকটি কারণ হচ্ছে, বোনদের সম্পদের প্রতি মোহ বা হক মেরে দেওয়ার ধান্ধা। যদি বোন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে এবং একটা সময় সম্পত্তি চেয়ে বসে তখন বোনকে সম্পত্তি দিতে হবে বলে বোনের সাথে আগে থেকেই দূরত্ব বজীয়ে রাখে যাতে এক সময় বোন বাবার বাড়িতে আসা যাওয়াই বন্ধ করে দেয় এবং বাবার বাড়ির হকের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।
আমাদের গল্পের সালমা বেগমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনায় ঘটে। সালাম সাহেবের মৃত্যুর পর সালমা তার বাবার বাড়িতে যাওয়া আসা একদমই কমিয়ে দেয় কারণ তার ভাই কালাম বোনের আসা যাওয়াতে বিরক্ত বোধ করতো। মুখে সরাসরি কিছু না বললেও আচার-আচরণে সেটি স্পষ্ট বোঝা যেতো। সালমা বেগমের ছেলেমেয়েরা যখন গ্রীষ্মের বা ডিসেম্বরের ছুটিতে মামার বাড়ি যেতে চায়, তখন দু’একবার সালমা বেগম না করা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েরা মামার বাড়িতে গিয়ে আদর আপ্যায়নের অভাব অনুভব করে, তখন তারা নিজ থেকেই মামার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

এভাবে আরো কিছুদিন যাওয়ার পর একসময় সালমা বেগম মৃত্যুবরণ করেন। সালমা বেগমের মৃত্যুকালে কালাম তখনও জীবিত ছিলেন। ঘটনার সূত্রপাত তখন থেকেই, সালমা বেগমের ছেলেমেয়েরা মামার বাড়িতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও নানার বাড়িতে মায়ের যে হক রয়েছে সেটি কেন ছেড়ে দিবে?
মায়ের মৃত্যুর পর মামাকে জানালো যে, মায়ের যে হক রয়েছে সেই হকটি তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু কালাম সাহেব এই বিষয়টি শুনেও না শোনার ভান করেন, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাছাড়া কালাম সাহেবের যে ছেলেরা রয়েছে তারাও এতটাই আগ্রাসন দেখায়, যাতে সালমা বেগমের সন্তানরা ভয়ে পিছপা হয়।
স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে বিয়ে দেওয়ার পরে তারা স্বামীর বাড়িতে চলে যাওয়ার কারণে বাবার বাড়িতে তাদের ওই ধরনের কানেকশন বা যোগাযোগ আর থাকে না। একই ভাবে দাদার বাড়িতে ছেলেমেয়েদের যেভাবে যোগাযোগ থাকে বা পরিচিত লোক থাকে, নানার বাড়িতে সেভাবে থাকেন না। যার ফলে সালমা বেগমের ছেলেমেয়েরাও কিভাবে সালমা বেগমের বাপের বাড়ির হক আদায় করবেন সে বিষয়ে কারো সহায়তা পাচ্ছিল না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সালমা বেগমের বাবার বাড়ির সম্পত্তি সরাসরি ওনার সন্তানরা কিভাবে তাদের নামে আনবেন?
অথবা, নানার বাড়িতে মায়ের হক কিভাবে সরাসরি নিজেদের নামে আনবে?
এ বিষয়ে প্রথমেই দেখতে হবে, সম্পত্তি কার নামে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নানার বাড়ির সম্পত্তি নানা বা নানীর নামে থেকে যায়। সেক্ষেত্রে নানা নানীর মৃত্যুর পর সম্পত্তি আগে মা-খালা, মামার নামে আনতে হয়। কিন্তু কিভাবে?
আমরা জানি যে, বাবা-মায়ের সম্পত্তি ছেলে মেয়েদের নামে করার পদ্ধতি দুটো।

প্রথমত, আপোষ বণ্টনের মাধ্যমে যার যার হিস্যা অনুযায়ী বণ্টন করা।
দ্বিতীয়ত, যদি আপোষ বণ্টন সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে আদালতে বাটোয়ারা মামলা করার মাধ্যমে।
তাহলে এখন বলুন তো, যদি নানা বা নানুর নামে সম্পত্তি থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে কি করতে হবে?
সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে প্রথমে আপনার মায়ের নামে সম্পত্তি আনতে হবে। এখানে অনেকেই মনে করেন যে, মা যেহেতু জীবিত নাই, নানা-নানীর সম্পত্তি সরাসরি নিজেদের (নাতিনাতনির) নামে নিয়ে আসা যায় কিনা?
না। এক ডিগ্রীকে বাদ দিয়ে সরাসরি লাফ দিয়ে সম্পত্তি আনার কোন প্রসেস বা প্রক্রিয়া সাধারণত নেই। তবে, যদি আপনার নানা নানী জীবিত অবস্থায় আপনাদেরকে হেবা বা উইল বা অসিয়ত করে দিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সম্ভব। কিন্তু যেহেতু আপনার নানা নানী জীবিত নেই, এখন যেটা করতে হবে তা হচ্ছে, নানা নানীর কাছ থেকে মায়ের নামে আনতে হবে।

বাবা মায়ের সম্পত্তি সন্তান যেভাবে নিজের নামে আনে ওই একইভাবে আপনার নানা নানীর সম্পত্তি প্রথমে আপনার মায়ের নামে আনতে হবে। অনেক তো প্যাচ হল, এখন নানা নানীর সম্পত্তি মায়ের নামে আনতে কি করতে হবে?
প্রথমে, মামা খালাদেরকে প্রস্তাব দিতে হবে আপোষ বণ্টনের জন্য। উনারা যদি এতে সম্মত হয় তাহলে আপন বণ্টনের মাধ্যমে সম্পত্তিতে কে কোন দিক থেকে কতটুকু হারে নিবে, সেটি আপোষ বণ্টন দলিল করে নিজ নিজ নামে নামজারি করে নিতে পারবেন। আর যদি আপোষ বণ্টনের রাজি না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনাদেরকে আদালতে বাটোয়ারা মামলা করতে হবে। আপোষ বণ্টনের চেষ্টা করা উত্তম, কেননা বাটোয়ারা মামলা সময় সাপেক্ষ।

তবে, বাটোয়ারা মামলা যেহেতু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার সেক্ষেত্রে খতিয়ান ধরে উত্তরাধিকার সনদ নিয়ে ভূমি অফিসে মায়ের হিস্যা অনুযায়ী নামজারির আবেদন করে দেখতে পারেন। নামজারি হবে কি হবে না সেটা ভূমি অফিসের বিষয় কিন্তু আবেদন করে মামা খালাদেরকে আপোষ বণ্টনের জন্য কৃত্রিম উপায়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন; তবে উদ্দেশ্য অবশ্যই ভালো হতে হবে।

 

এবার আসুন যদি, মামারা চালাকি করে নানা নানীর সম্পত্তি নিজেদের নামে রেকর্ড করিয়ে রাখে, সেক্ষেত্রে তো তখন আর নানা নানীর নামে সম্পত্তি থাকছে না, মায়ের সম্পত্তি আদায় করবেন কিভাবে?
এক বাক্যে বললে, রেকর্ড সংশোধনের মামলা করে খতিয়ানে একচেটিয়া মামাদের নাম সংশোধন করে হিস্যা অনুযায়ী মায়ের নাম খতিয়ান ভুক্ত করতে হবে। এ বিষয়টি যাদের কাছে নতুন বা ঝামেলাটি কি এবং কিভাবে সমাধান করতে হবে এ বিষয়ে জানতে ইচ্ছুক, তারা বরং আমাদের ওয়েবসাইট থেকে রেকর্ড সংশোধনের মামলা সংক্রান্ত আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেন। আজকে এ পর্যন্তই, আল্লাহ্‌ হাফেজ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্যাংকের নমিনি কাকে করবেন? 

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ভাই থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী: মুসলিম উত্তরাধিকারে স্ত্রী-কন্যা ও ভাইয়ের লড়াই