যৌথ বা এজমালি সম্পত্তি ক্রয়ের পূর্বে যে বিষয়গুলো দেখবেন

যৌথ মালিকানা জমি কেনার আগে

জয়নাল আবেদীন সাহেব মৃত্যুকালে ৫৩ শতাংশ জমিয়ে রেখে যান। উনার স্ত্রী উনার পূর্বেই পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে উনার চার সন্তান ছিল, দুই ছেলে দুই মেয়ে। চার সন্তানের সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। দুই মেয়ে বিবাহ করে স্বামীর সংসারে থাকলেও তাদের একজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
অন্যদিকে দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই আমেরিকায় থাকে, আরেকজন দেশে সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তারা আর গ্রামে নিয়মিত যায় না। না যেতে যেতে তাদের মধ্যে বাড়ির প্রতি মায়া মমতা আকর্ষণ বোধ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে।

এখনকার দিনে যেমন হয়, বাবা-মা অনেক শখ করে যে বাড়ি তৈরি করেন, সারা জীবন বিভিন্ন স্মৃতি লালন করেন, ঐতিহ্য আকড়ে ধরে রাখেন, সন্তানরা কে কিভাবে থাকবে সেই ধরনের পরিকল্পনা করে থাকেন, স্বপ্ন দেখে থাকেন; অথচ সেই বাবা মায়ের মৃত্যুর পর ঐ বাড়ির প্রতি সন্তানদের আর তেমন মায়া মমতা থাকে না।
যার ফলে দেখা যায়, উক্ত সম্পত্তি অবহেলায় দিন দিন আরো নষ্ট হতে থাকে। কেউবা সেটি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য পায়তারা করে। তেমনি ভাবেই জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুর পর তার সন্তানেরাও ঐ সম্পত্তিতে না আসতে আসতে ঐ বাড়িটি ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে।

এভাবে চলতে চলতে একসময় দেশে থাকা তিন ভাই বোন ঠিক করে গ্রামের ঐ সম্পত্তিটি বিক্রি করে দিবে। কেননা দুই বোনের স্বামীর নামে শহরে জায়গা কিনে নিজেরা বাড়িঘর করেছে, সরকারি উচ্চ পদস্থ যে কর্মকর্তা তিনিও শহরে জায়গা ক্রয় করেছেন, এখন বাড়ি করার পালা। তাই, ৩ ভাইবোন মিলে যে ভাই আমেরিকায় থাকেন, তাকে ঐ সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব দিল।
আমেরিকাতে থাকা ঐ ভাই ঐ সম্পত্তি বিক্রি করতে আপত্তি করে। তার যুক্তি হচ্ছে, দেশে আসলে ঐ বাড়িই হবে আমাদের কেন্দ্রস্থল হওয়া উচিত, আমাদের হয়তো নিয়মিত থাকা হবে না কিন্তু বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করা থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজনের সাথে মাঝে মাঝে দেখাশোনা করার জন্য হলেও ঐ বাড়িটি থাকা উচিত।
তাছাড়া ঐ ৫৩ শতক জমি বিক্রি করে খুব বেশি টাকা যে পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়। কেন শুধু শুধু বিক্রি করে বাবা-মায়ের এত পরিশ্রমের বাড়িতে অন্যের হাত তুলে দিবে, তাই আমেরিকান প্রবাসী ঐ ভাই সরাসরি আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু দেশে থাকা তিন ভাই বোন চিন্তা করল শুধু শুধু বাড়িতে ওই সম্পত্তিটি পড়ে থেকে কোন লাভ নেই, এর মধ্যে বাড়িতে না থাকার কারণে চোর বাটপাররা এসে আজকে এটা, কালকে ঐটা খুলে নিয়ে যাচ্ছে, এতে যতদিন যাবে সম্পত্তিটি আরো বেশি নষ্ট হবে। বাড়িতে লাগানো গাছগাছালি গুলো মানুষ নষ্ট করে দিচ্ছে, ফলমূল তো খেয়ে শেষ দিচ্ছে তাতে সমস্যা নেই কিন্তু যার যেমন দরকার লাড়কির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন গাছ গাছালি নষ্ট করছে। এভাবে পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়ার চেয়ে ভালো কারো কাছে বিক্রি করে দিলে তারা সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে।

তাই তারা ৩ জন প্রবাসী ভাইকে ক্রয় করার জন্য প্রস্তাব দেয়, কিন্তু সে নিজে ক্রয় করতেও আপত্তি জানায়। তখন বাকি তিন ভাই বোন ঐ বাড়ি বিক্রি করার জন্য এলাকাতে যারা জমির ব্যবসা করে তাদেরকে প্রস্তাব দেয়। এখন কথা হচ্ছে এই যে যৌথ বা এজমালি সম্পত্তি, যে সম্পত্তির মালিক চার ভাই বোন তাদের মধ্যে তিন ভাইবোন বিক্রি করতে রাজি থাকা সত্ত্বেও আরেক যে ভাই আপত্তি করেছে, সেই ভাই বিক্রিতে রাজি না থাকলে সেক্ষেত্রে একজন ক্রেতা হিসেবে আপনার ঐ জমি ক্রয় করা উচিত কিনা?

এখন একজন ক্রেতা চাইলে ঐ ৫৩ শতক জমির মধ্যে এক ভাই এবং দুই বোনের যে হিস্যা বা অংশ রয়েছে, সেই অনুসারে জমি ক্রয় করতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটা হবে যেহেতু চার ভাই বোনের মধ্যে সম্পত্তি এখনো বণ্টন হয়নি, তারা চার ভাই বোন মিলে ঐ সম্পত্তির মালিক হলেও ঐ সম্পত্তিতে কে কোন দিক থেকে নিচ্ছে, কে কতটুকু করে নিচ্ছে সেটি কিন্তু এখনো স্পষ্টীকরণ করা হয়নি। যার ধরুন, একজন ক্রেতা তিন ভাইবোনের হিস্যা অনুযায়ী সম্পত্তিটি ক্রয় করার পর যেহেতু সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি বা চৌহদ্দি নির্ধারণ করা হয়নি, সেক্ষেত্রে যদি আমেরিকান প্রবাসী বাকি ভাই কখনো দেশে এসে বলে যে ঐ জমিতে আমার যে হিস্যা আছে, সেটি আমি আমার মত করে নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে নিবো, যে জায়গা দিয়ে জমি নিলে ক্রেতা খুবই বিপদে পড়তে পারে, তখনি শুধু হবে বিরোধ, বিপত্তি, অশান্তি।

যেমন ধরুন, ৫৩ শতক জমির মধ্যে গ্রামীণ বাড়ির পাশাপাশি যে ঘরটি রয়েছে ঐ ঘরটি বিল্ডিং এবং এর জন্যই ক্রেতা একটি বিশেষ মূল্য প্রদান করল। কিন্তু প্রবাসী ভাই এসে বলল যে, সে তার হিস্যা অনুযায়ী দখল নিবে ঠিক ঘর যেখানে আছে সেখানে। আবার ধরুন, পুরো জমির মধ্যে যে জায়গা দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলাচল করা হয় সেই জায়গা দাবী করে বসল প্রবাসী ভাই বা যে জমিটুকু রাস্তের পাশে ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যার ফলে এর মূল্যমানও অপেক্ষাকৃত বেশি সেটি প্রবাসী ভাই দাবী করে বসল; তখন সেক্ষেত্রে ক্রেতা কিন্তু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তাই এখনকার দিনে যৌথ বা এজমালি সম্পত্তি বিক্রয় করার ক্ষেত্রে বণ্টন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, বণ্টন ব্যতীত কেউ যদি এজমালি সম্পত্তি তার নিজ হিস্যা অনুযায়ী বিক্রি করেও, সেক্ষেত্রেও ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদি বাকি কোন অংশীদার এসে ক্রেতাকে তার সীমানা বা চৌহদ্দি নিয়ে ঝামেলা করে, তখন ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাই একজন ক্রেতা হিসেবে উচিত হচ্ছে, এজমালি সম্পত্তি ক্রয় করার পূর্বে তাদের আপোষবন্টন দলিলটি দেখে নেওয়া বা বাটোয়ারা মামলার মাধ্যমে সম্পত্তি যেভাবে বাটোয়ারা হবে সেই অনুযায়ী চৌহদ্দি নির্ধারণ করা থাকা অবস্থায় সম্পত্তি ক্রয় করা। এতে ভবিষ্যতে মামলা মোকদ্দমা থেকে শুরু করে প্রতিবেশীর বিড়ম্বনা থেকে আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন।
অনেকেই আপনাকে পরামর্শ দিবে, আপনি বণ্টন দলিল ছাড়াই শুধুমাত্র তিনজনের হিস্যা অনুযায়ী সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন, কিন্তু এতে ভবিষ্যতে আপনি বাকি অংশীদারদের যেমন বিড়ম্বনায় পড়বেন, তেমনিভাবে সারাজীবন ঐ জায়গায় যে প্রতিবেশীরা থাকবে তাদের সাথে আপনার একটি শত্রু ভাবাপন্ন সম্পর্ক বজায় থাকবে।

বিক্রেতা বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে যাবে, দালাল তার কমিশন নিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমবে আর আপনি আপনার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে কোন সম্পত্তি ক্রয় করার পর ফ্রিতে কিছু শত্রু পাবেন আর প্রতিনিয়ত সীমান্তে বসবাসের অনুভূতি পাবেন। তাই, কব্জির জোরে বা কারো প্রলোভনে না পড়ে বণ্টন কৃত জমি নিজের চৌহদ্দি বুঝেশুনে জমি ক্রয় করুন।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়