অনেক সময়ই আমাদের অনেকের মনে এই প্রশ্নটি উঠে যে, একটি দলিল কখন থেকে কার্যকর হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে বা আপনি একটি দলিল কবে থেকে কার্যকর হচ্ছে বলে ধরে নিবে; দলিলটি যে দিন সম্পাদন করা হয়েছে সে দিন থেকে নাকি দলিলটি যে দিন রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে সে দিন থেকে?
সাধারণত আমরা জানি যে, একটি দলিল প্রথমত দুই বা ততোধিক পক্ষদের মধ্যে লেখালেখি সম্পাদন করা হয়ে থাকে, যাকে আমরা সম্পাদনা বলে থাকি। তারপর উক্ত দলিলটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করা হয়ে থাকে। এখন আপনার আমার মতো অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসে যে, উক্ত দলিলটি কবে থেকে কার্যকর করা হয়েছে বা কবে থেকে এই দলিলের কার্যকারিতা শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে, যে দিন দলিলটি সম্পাদন করা হয়েছে সে দিন থেকে নাকি সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন বা রেজিস্ট্রি করা হয়েছে সে দিন থেকে?
যৌক্তিকভাবে সাধারণত আপনার আমার সকলের মাথায় আসে, যে দিন দলিল রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে সে দিন থেকে কার্যকারিতা শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। কিন্তু এই জায়গায় হচ্ছে ব্যতিক্রম হচ্ছে, দলিল যে দিন রেজিস্ট্রি করা হয়েছে সেদিন থেকে দলিলের কার্যকারিতা শুরু হয় না, বরং একটি দলিল রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন যদি না থাকে তাহলে যেদিন থেকে দলিলটি কার্যকর হওয়ার কথা সেদিন থেকে দলিলটি কার্যকর হবে, অর্থাৎ সম্পাদনের দিন থেকে।
এখন কথা হচ্ছে, একটি দলিল রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন যদি না থাকে তাহলে কবে থেকে দলিলটি কার্যকর হবে? আপনি উত্তর দিবেন যদি রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন না থাকে সে ক্ষেত্রে দলিলটি যে দিন সম্পাদন করা হয়েছে অর্থাৎ যে দিন দলিলটি লেখা হয়েছে এবং পক্ষদ্বয় ও সাক্ষীগন যে দিন স্বাক্ষর করেছেন, সে দিন থেকে দলিলটি কার্যকর হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। আরো সহজ করে বললে, দলিলটি যে দিন সম্পাদন করা হয়েছে এবং সম্পাদনের তারিখ যে দিন উল্লেখ করা হয়েছে, সে দিন থেকেই মূলত দলিলের কার্যকারিতা শুরু হবে।
এখন কথা হচ্ছে, কোন দলিল সম্পাদন করার পর যদি রেজিস্ট্রেশন করতে বিলম্ব হয়, সেক্ষেত্রে কি হবে? রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ২৩ ধারা অনুসারে উইল বা ওসিয়ত, বিদেশের সম্পাদিত কোন দলিল এবং বায়নাপত্র দলিল ছাড়া বাকি সকল দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রির জন্য দলিলটি রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করতে হবে। অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত ৩ ধরনের দলিল ছাড়া বাকি সকল দলিল যে দিন আপনি সম্পাদন করবেন, সেই দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে অবশ্যই রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে।
এখন আপনার মনে আবার প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে উপরে যে ৩ টি দলিলের কথা বলা হয়েছে, সেই দলিল গুলোর ক্ষেত্রে কবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে?
প্রথমত, উইল বা ওসিয়ত দলিল সম্পাদনের পর যেকোনো সময় রেজিস্ট্রেশনের জন্য দাখিল করা যাবে। কারণ আমরা জানি উইল বা ওসিয়ত এই বিষয়গুলো যেকোনো সময় পরিবর্তন করা যায়। কেননা, উইল বা ওসিয়ত কার্যকর হয় যে ব্যক্তি উইল বা ওসিয়ত করেছেন, তার মৃত্যুর পরে। যার ফলে ওই ব্যক্তি তার মৃত্যুর পূর্বে যে কোন সময় তার উইল বা ওসিয়ত রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। অনেকে একই সম্পত্তির উপর সময়ে সময়ে একাধিক উইল বা ওসিয়ত করে থাকেন এবং পরবর্তীতে পরিবর্তন করে থাকেন। যার ফলে সর্বশেষ উনি যে উইল বা ওসিয়ত সম্পাদন করে রেজিস্ট্রেশন করবেন সেটি কার্যকারিতা পাবে। তাই, উইল বা ওসিয়তের ক্ষেত্রে সম্পাদনের পর কতদিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, সে বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উইল বা ওসিয়তকারী নিজের ইচ্ছে মত বা সুযোগ সুবিধা অনুসারে দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭ (এ) ধারা অনুযায়ী, বায়না পত্র দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য দাখিল করতে হবে। কোন সম্পত্তি বা জমিজমা ক্রয় বিক্রয়ের পূর্বে অনেকেই বায়না পত্র দলিল করে থাকে। উক্ত বায়না পত্র দলিলে মূলত সম্পত্তিটি কত টাকায় বিক্রি হবে, কবে বিক্রি হবে এবং বর্তমানে এডভান্স বা অগ্রিম বাবদ কত টাকা প্রদান করা হচ্ছে ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তাই, এই বায়না পত্র দলিলের গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়। তাই, বায়না পত্র দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
তৃতীয়ত, রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ২৬ ধারা অনুযায়ী, বিদেশের সম্পাদিত কোন দলিল বাংলাদেশে প্রবেশের তারিখ থেকে চার মাসের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য দাখিল করতে হবে। বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনেক সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে কোন পক্ষ দেশের বাহিরে থাকলে তখন দেশের বাহিরেই দলিল সম্পাদন করতে হয়। তখন, ঐ দলিল দেশে প্রবেশের দিন থেকে ৪ মাসের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
তাহলে আমরা দেখতে পেলাম যে, উইল বা ওসিয়ত, বায়না পত্র দলিল এবং বিদেশের সম্পাদিত দলিলের ক্ষেত্রে যথাক্রমে যে কোন সময়, এক মাস এবং চার মাসের মধ্যে সম্পাদনের পর রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করতে হবে। অন্যথায় বাকি সকল দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নিকট দাখিল করতে হবে।
তাছাড়া, আদালতের ডিক্রি বা আদেশের নকলের ক্ষেত্রে ডিগ্রী বা নকলের আদেশ দানের তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে বা ক্ষেত্র বিশেষে উক্ত ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল চূড়ান্ত হওয়ার তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রির জন্য সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করতে হবে।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে, সময় মত রেজিস্ট্রেশন করলে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল কার্যকর হবে মূলত সম্পাদনের তারিখ থেকে। তবে সম্পাদিত লিখিত দলিল সময়মত রেজিস্ট্রেশন করা না হলে সেই সম্পাদিত দলিলের কার্যকারিতা থাকে না।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )