একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

নোয়াখালীর এক গ্রামের বাসিন্দা রমিজ মিয়ার জমি নিয়ে আজকের ঘটনার সূত্রপাত। ২০০৮ সালে রমিজ মিয়া তার ছেলের বিদেশ পাঠানোর উদ্দেশ্যে নগদ অর্থের প্রয়োজন পড়লে তার একটি ১২ শতাংশের জমি বিক্রি করেন তার প্রতিবেশী সেলিম সাহেবের কাছে। সেলিম সেই জমি নিজের নামে নামজারি করেন এবং নিয়মিত খাজনা দিয়ে আসছেন। বছর খানিক পরেই, অর্থাৎ ২০১০ সালে, সেলিম তার জমি আবার বিক্রি করেন তরুণ ব্যবসায়ী আব্দুল করিমের কাছে। করিম সেই জমি নিজের নামে নামজারি করেন এবং খাজনা পরিশোধ করে আসছেন আজ অবধি।  

এভাবে প্রায় এক দশকের বেশী সময় কেটে যায়, করিম নিশ্চিন্তে নিজের জমি চাষাবাদ করছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে রমিজ মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ সেই জমি নিজের নামে নামজারি করে এবং ঘটনা এতদূর গড়ায় যে, আব্দুল্লাহ ওই জমি বিক্রির জন্য এলাকার মধ্যে কয়েকজনকে প্রস্তাব দেয়। 

বিষয় এক কান দুই কান করে করিমের নলেজে আসে, কিন্তু সে ভেবে কূল পায় না যে, একই জমিতে আবার আরেকজনের নামজারি কিভাবে সম্ভব, তাও আবার কোনো সাধারণ ব্যক্তি নয়, রমিজ মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ! করিম খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন, কারণ এতদিন ধরে তিনি এই জমি তার নিজের বলে জানতেন এবং খাজনাও নিয়মিত দিয়েছেন। 

একদিন করিম ঠিক করলেন তিনি উকিলের সাথে আলোচনা করবেন। তিনি রমিজ মিয়ার পুত্রের এই নামে নামজারি কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে চান। করিম দ্রুতই তাদের গ্রামের উকিলবাবুর কাছে গেলেন।

উকিলবাবু করিমের পুরো ঘটনা শোনার পর বললেন, “আপনার জমি আপনি নিয়মমাফিকই কিনেছেন এবং নামজারি করেছেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রথমত, আপনি যে দাগের জমির ক্রয় করেছেন খতিয়ান অনুযায়ী সেই দাগে জমির পরিমাণ সম্বন্ধে জানুন। যদি আপনার কেনা জমির বাইরে ঐ দাগে আরও কোনো জমি থেকে থাকে, তবে সেটি আব্দুল্লাহ ওয়ারিশসূত্রে পেতে পারে এবং বিক্রির চেষ্টা করতে পারে; এখানে আইনত কোন বাঁধা নেই। কিন্তু যদি একই দাগের আপনার জমিটুকুই সে তার নামে নামজারি করিয়ে থাকে, তাহলে এখানে আইনত ঝামেলা আছে।”

উকিলবাবু করিমকে একটি পরামর্শ দিলেন, ” আপনি প্রথমে স্থানীয়ভাবে আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করুন। ঘটনাটা কি সেটা আপনারা আগে জেনে তারপর এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে বসুন। প্রয়োজনে চেয়ারম্যান, মেম্বারকে সাথে নিয়ে বসুন। কিন্তু যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে আব্দুল্লাহর নামজারি বাতিলের জন্য এসিল্যান্ড বরাবর দ্রুত একটি আবেদন করুন। যদি তা দিয়েও সমাধান না হয়, তাহলে আপনাকে আদালতে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করতে হবে। এই ধরনের সমস্যায় আদালতের মাধ্যমে জমির প্রকৃত মালিকানা নিশ্চিত করতে হয়।”

করিম উকিলবাবুর পরামর্শ মেনে স্থানীয়ভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আব্দুল্লাহ তার দাবিতে অনড় থাকলেন। তখন করিম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি এসিল্যান্ডের অফিসে গিয়ে আবেদন করবেন এবং প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হবেন। উকিলবাবুর কথায় করিম কিছুটা আশ্বস্ত হলেন যে, তার জমির অধিকার ফিরে পাবার পথ এখনো খোলা আছে।

উপরের ঘটনাটি সত্য, কিন্তু নামগুলো কাল্পনিক। আমরা এই গল্পের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করলাম যে, একই জমি যদি একাধিক ব্যক্তির নামে নামজারি করা থাকে তবে সেটা কিভাবে সংশোধন করতে হয় এবং পাশাপাশি কিভাবে এই ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হয়। নিম্নে আমরা এসি ল্যান্ড অফিসে কিভাবে আবেদন করবেন, তার একটা সম্ভাব্য ফরম্যাট দিয়ে দিচ্ছি। যদিও আপনি এসি ল্যান্ড অফিসে গেলে সেখানেও ওনাদের নির্ধারিত ফরম্যাটে আবেদন করতে পারেন, তবে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য ফরম্যাটটি নিম্নে বর্ণিত হলঃ

নামজারি বাতিলের জন্য এসিল্যান্ড বরাবর আবেদন ফরম্যাট

তারিখ: [আপনার আবেদনের তারিখ]  

বরাবর,

এসিল্যান্ড,  

[উপজেলার নাম]  

[জেলার নাম]

বিষয়: একই জমিতে দুইজনের নামে নামজারি থাকার কারণে নামজারি বাতিলের জন্য আবেদন।

জনাব,  

বিনীত নিবেদন এই যে, আমি [আপনার নাম], পিতা/স্বামী: [পিতার/স্বামীর নাম], গ্রাম: [গ্রামের নাম], পোস্ট অফিস: [পোস্ট অফিসের নাম], থানা: [থানার নাম], জেলা: [জেলার নাম] এর স্থায়ী বাসিন্দা। আমি [বিক্রেতার নাম] এর কাছ থেকে [জমির পরিমাণ] শতাংশ/কাঠা জমি কিনেছি [তারিখ] সালে এবং আমার নামে নিয়মমাফিক নামজারি করেছি। এই জমির খাজনাও আমি নিয়মিত দিয়ে আসছি, যার প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সংযুক্ত করেছি।

কিন্তু সম্প্রতি জানতে পারলাম যে, একই জমি [যার নামে নামজারি] নামে আবার নামজারি হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনের পরিপন্থী, কারণ একই দাগে দুইজনের নামে নামজারি থাকা সম্ভব নয়। জমিটি [যার নামে নামজারি] এর পূর্বেই আমি আমার নামে রেজিস্ট্রি করে ক্রয় করেছি, তারপর নামজারি করা হয়েছে এবং প্রতি বছর খাজনা দিয়ে আসছি।

অতএব, মহোদয়ের নিকট বিনীত প্রার্থনা এই যে, আপনি জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে আমার নামে থাকা নামজারির বৈধতা নিশ্চিত করবেন এবং অন্যায়ভাবে করা নামজারি বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

নিবেদন

[আপনার নাম], 

পিতা/স্বামী: [পিতার/স্বামীর নাম], 

গ্রাম: [গ্রামের নাম], পোস্ট অফিস: [পোস্ট অফিসের নাম], 

থানা: [থানার নাম], জেলা: [জেলার নাম]

মোবাইল নম্বর: [আপনার ফোন নম্বর]  

ই-মেইল: [আপনার ই-মেইল] 

সংযুক্তি:

১। জমির দলিলের ফটোকপি  

২। খাজনার রশিদ  

৩। নামজারি সনদের ফটোকপি  

৪। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি  

যদি আরও কিছু থাকে, আপনি জমির বিস্তারিত তথ্য এবং প্রমাণাদি সংযুক্ত করতে পারেন। আশা করি, এই ফরম্যাটটি আপনাকে এসিল্যান্ডের কাছে জমির নামজারি বাতিলের জন্য আবেদন করতে সাহায্য করবে।  

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়

বাবা/স্বামীর মৃত্যুর পর চাচা/দেবরদের দ্বারা বেদখল হলে করনীয় কি?