জমি আগে রেজিস্ট্রি করবো নাকি দখল বুঝে নিবো?

জমি-জমার আইন

একটা প্রশ্ন অনেকেই বিভিন্ন ভাবে করে থাকে যে, জমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে আগে কি রেজিস্ট্রি করবো নাকি আগে জমির দখল বুঝে নিব? এই প্রশ্নটি শুনলেই আমার ঐ পুরনো প্রশ্নটি মনে পড়ে যায় যে, ডিম আগে না মুরগি আগে? কারো মতে ডিম আগে তো কারো মতে মুরগি আগে। যদিও ডিম আগে হওয়ার সম্ভাবনা নাই, মুরগি আগে হওয়া সম্ভাবনাটাই বেশি। কারণ পৃথিবীতে আগে মানুষ আসছে তারপরে মানুষের বাচ্চা আসছে। তেমনি ভাবে মুরগি আগে এসেছে সাথে মোরগকে নিয়ে, তারপর তাদের প্রেম ভালোবাসার পরিণতি হিসেবে ডিম এসেছে পৃথিবীতে। তারপর মুরগির বংশ বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু আমাদের এই প্রশ্নটি খুবই জটিল যে, একটি জমি ক্রয় করার সময় আগে কি জমি রেজিস্ট্রি করব নাকি আগে জমির দখল বুঝে নিবো। 

এই ক্ষেত্রে, আপাতদৃষ্টিতে আইনগতভাবে যদি উত্তর দিতে যাই আমরা সেক্ষেত্রে সবার আগে বলবো যে, জমির রেজিস্ট্রেশন আগে করে নেওয়া উচিত। কেননা একটি জমি ক্রয় করার মাধ্যমে অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে ওই জমিতে আপনার অধিকার তৈরি হয়, এর আগে আপনার ওই জমিতে কোন অধিকার তৈরি হয় না। অধিকার তৈরি না হলে আপনি দখল দিয়ে কি করবেন? আগে অধিকার তৈরি করুন তারপর দখল বুঝে নিন। এতোটুকু পর্যন্ত পড়লে আপনার কাছে মনে হবে যে, হ্যাঁ, একটি জমি আগে ক্রয় করে রেজিস্ট্রেশন করা উচিত, তারপর দখল বুঝে নেওয়া যাবে। কিন্তু আমি যদি বলি যে, বাংলাদেশে এমন বহু জমির দলিল সৃষ্টি করা হয়েছে, যে জমির কোন অস্তিত্বই নেই। বর্তমানে কিছুটা কমলেও নিকট অতীতে অনেক বেশি দলিল হয়েছে যে দলিলগুলোর বিপরীতে বাস্তবে কোন জমিও নেই। যদি জমি থেকেও থাকে সেক্ষেত্রে একই জমি বিক্রি হয়েছে একাধিকবার। বিক্রেতা একই কিন্তু ক্রেতা ভিন্ন ভিন্ন; যার ফলে আপনি জমি করে দখল নিতে গিয়ে দেখবেন যে, সেই জমির দখল নিয়ে ইতিমধ্যে আরো অনেকজন মামলা মোকদ্দমা করেছে বা মারামারিতে জড়িত হয়েছে অথবা জমির অস্তিত্বই নেই। তাহলে, বুঝুন রেজিস্ট্রেশন করে কি লাভ হল যখন জমির দখলেই খবর নেই। ট্রেনের যেই সীটের জন্য টিকেট কাটলেন, সেই সীট ইতিমধ্যে কয়েকবার বিক্রি হয়ে গেছে বা ঐ ট্রেন ইতিমধ্যে ছেড়ে গেছে বা ঐ নামে কোন ট্রেনই নেই। যাবেনটা কোথায় আপনি?

আরেক ক্যাটাগরির ক্রেতা আছে যারা প্রশ্ন করে যে, আমি জমি ক্রয় করার পূর্বে বাউন্ডারি দিতে চাই, তারপর জমি ক্রয় করতে চাই। এখন অধিক নিরাপত্তার জন্য সেই বিষয়টি ঠিক আছে, কেননা আপনি যখন কারো জমিতে বাউন্ডারি দিতে যাবেন তখন ঐ জমি যদি ইতিমধ্যে অন্য কারো কাছে বিক্রি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কেউ না কেউ বাধা দিতে আসবে। যদি কোন বাধা না আসে, তখন আপনি শিউর হতে পারবেন যে ওই জমিটি বিক্রেতার মালিকানাধীন। 

কিন্তু, বিপত্তি হবে আপনি যদি বিক্রেতাকে তার জমি আপনাকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার পূর্বেই তার জমিতে আপনি বাউন্ডারি তুললেন এবং তারপরই বিক্রেতা যদি জমি বিক্রি করতে রাজি না হয়, তাহলে এই যে বাউন্ডারি করার যে খরচটি সেটা কিন্তু আপনার পকেট থেকেই গেল। বিক্রেতা যদি অস্বীকার করে সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনি ওই বাউন্ডারি করার টাকা বিক্রেতার কাছ থেকে আদায় করতে যথেষ্ট ভোগান্তির শিকার হবেন। তাই রেজিস্ট্রেশন কিংবা বাউন্ডারি বা দখল এসব বিতর্কে যাওয়ার আগে আপনার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে, জমির কাগজপত্র গুলো সঠিকভাবে যাচাই করা। তারপর, একজন আমিন বা সার্ভেয়ারকে দিয়ে পুরো জমিটি মাপ দেওয়া। কারণ কাগজপত্র যদি আপনার ঠিক থাকে, তারপর আপনাকে দেখতে হবে দখল ঠিক আছে কিনা। দখল ঠিক আছে কিনা এটা দেখার জন্য যখন আমিনকে নিয়ে মাপতে যাবেন তখন ওই জমির যদি অন্য কোন দাবিদার থাকে তারা অবশ্যই এসে সেখানে আপনাদেরকে বাধা দিবে। তখন আপনি জানতে পারবেন ওই জমির প্রকৃত মালিককে। আর যদি মাপার সময় কেউ বাধা না দেয় তখন আপনি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারেন যে, বিক্রেতাই ওই জমির প্রকৃত মালিক। তারপরেও আপনি পুরো টাকা একসাথে না দিয়ে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে আগে বায়না পত্র দলিল করবেন এবং বায়নাপত্র রেজিস্ট্রেশন করবেন। এর সাথে সাথে জমিতে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিবেন, যেখানে উল্লেখ করা থাকবে যে, বায়না সূত্রে এই জমির মালিক আপনি। তাহলে বাকি টাকা পরিশোধ এবং রেজিস্ট্রেশন হওয়া পর্যন্ত যদি কারো কোন আপত্তি থাকে বা দাবি থাকে সেটা আপনার সাথে সে যোগাযোগ করবে। সেজন্য সাইনবোর্ডে অবশ্যই আপনার মোবাইল নাম্বার দিয়ে আসবেন এবং খোঁজখবর রাখবে সাইনবোর্ডটি ঠিকঠাক আছে কিনা। অনেক সময় দেখা যায়, আপনি সাইনবোর্ড দিয়ে এসেছেন তার কিছুক্ষণ পরেই বিক্রেতা নিজে বা তার লোকজন দিয়ে সাইনবোর্ড ফেলে দিয়েছে।

টাকা দিয়ে সময় মানুষ সুখ কিনে বা সম্পদ কিনে; কিন্তু কেউ যদি টাকা দিয়ে ঝামেলাযুক্ত জমি কিনে থাকে, সেক্ষেত্রে সে টাকা দিয়ে অশান্তি কিনে নিল। না পারবেন জমির প্রতি আপনার মায়া ছেড়ে দিতে, না পারবেন জমিতে আপনার অধিকার খাটাতে। তাই অবশ্যই ক্রয় করার পূর্বে তড়িঘড়ি করবেন না। পকেটে টাকা থাকলে কোন জিনিস ক্রয় করার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে, তখন ক্রেতার মনে এক ধরনের চাঞ্চল্যতা কাজ করে, যেটাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক বিক্রেতারা তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। তাই অবশ্যই অবশ্যই সাথে বিচক্ষণ এবং ঠান্ডা মাথার লোক রাখবেন যে, আপনার হয়ে কাজটি করবে। জমির নথিপত্র সঠিকভাবে যাচাই করা এবং সরজমিনে সঠিকভাবে দখল আছে কিনা সেটা যাচাই করে, তারপরেই কেবল জমি ক্রয় করা উচিত। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি রেজিস্ট্রেশন কিংবা দখল, কোনটি আগে কোনটি পরে না করে বরং একসাথেই যাচাই করা উচিত। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.