রেকর্ড সংশোধন আইন

জমির দলিলে সম্পত্তি বেশি কিন্তু রেকর্ডে কম হলে করণীয় কি?

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

জমিজমা সংক্রান্ত আমাদের দেশে যতো সমস্যা তৈরি হয়, তার বেশির ভাগ সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময়। ‘Manufacture defect বা তৈরির সময়ই ত্রুটি’ বলে একটা কথা আছে। জমিজমার বেলায়ও ত্রুটিটা হয়ই হস্তান্তরের সময় এবং রেকর্ডের সময়। যদিও রেকর্ডের সময়ের ত্রুটি হওয়াটা স্বাভাবিক; সারাদেশের এতো জমির রেকর্ড করতে গেলে একটু আধটু এদিক সেদিক হয়েই থাকে, তার উপর যান্ত্রিক ত্রুটি তো আছেই। তারপরও সরকার রেকর্ড কার্যে ত্রুটি সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে যাতে কারো সম্পত্তি রেকর্ড করার সময় নাম, ঠিকানা, জমির পরিমাণ, হিস্যা, জমির শ্রেণী ইত্যাদি কোন কিছুতে ভুল হয়ে থাকলে সংশোধন করা যায়। কিন্তু, জমি কেনার সময় যে ত্রুটিগুলো তৈরি হয়, সেগুলো হয় ইচ্ছাকৃত নয়ত অবহেলা জনিত। আর এই ভুলের মাশুল গুনতে হয় বছরকে বছর।
জমি সংক্রান্ত আরেকটা তথ্য আমাদের অনেকেরই অজানা যে, জমি আমরা কেনাবেচা করে থাকি একজন থেকে আরেকজন দলিলের মাধ্যমে। দলিলের মাধ্যমে আমরা আমাদের মালিকানা হস্তান্তর করে থাকি এবং এটি প্রক্রিয়াজাত করে থাকে আপাদমস্তক প্রত্যেক থানা বা উপজেলায় অবস্থিত সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।

অন্যদিকে প্রতিটি জমির অবস্থান বা দখলের ভিত্তিতে রেকর্ড করে সরকার যে নথি প্রস্তুত করে সেটা হচ্ছে, খতিয়ান। খতিয়ানে প্রতিটি গ্রামকে মৌজা ধরে সিরিয়ালে বিভিন্ন পরিমাণে জায়গা নিয়ে দাগ নাম্বার দিয়ে রেকর্ড করা হয়। আর, প্রতিটি দাগে কে বা কারা দখলে আছে এবং কে কতটুকু পরিমাণ দখলে আছে সেটাও উল্লেখ থাকে। জমিটির শ্রেণী কি, সেটি কি ভিটা বাড়ি, নাকি নাল (জমি), খাল, খাস ইত্যাদি জরিপ করা হয় রেকর্ডের ভিত্তিতে। রেকর্ডের সময় একদিকে যেমন খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়, জমিতে কে দখলে আছে সেটা নিশ্চিত করতে, অন্যদিকে একটা ম্যাপ ও প্রস্তুত করা হয় পুরো মৌজা / গ্রামের অবস্থান বুঝতে।
এরপর ভূমি অফিসের কাজ হচ্ছে, একদিকে জমির খাজনা বা বাৎসরিক যে কর রয়েছে সেটা আদায় করা এবং পাশাপাশি দলিলের মাধ্যমে অর্থাৎ ক্রয় বিক্রয়, হেবা, বাটোয়ারা, দান ইত্যাদির মাধ্যমে জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে সেটা সরকারি যে রেকর্ড রয়েছে সেখান থেকে পূর্বের মালিকের নাম বাতিল করে নতুন মালিকের নাম বসানো।পূর্বের মালিকের নাম বাতিল করে নতুন মালিকের নাম বসানোর প্রক্রিয়াটিকেই আমরা সাধারণত খারিজ নামে জানি। খারিজ অর্থ বাতিল বা কর্তন অর্থাৎ, পূর্বের মালিকের নাম খারিজ করে নতুন মালিকের নাম বসানো। খারিজ, জমা খারিজ ইত্যাদি নামে আঞ্চলিকভাবে বললেও মূলত নামজারি হিসেবেই এটি প্রসিদ্ধ। সরকারি ভাবে উক্ত জমির মালিক উনি, এটা ঘোষণা বা জারির নামই নামজারি।

এবার মূল বিষয়ে আসা যাক, এই দলিল করার সময় যদি আমি আমার জায়গায় পরিমাণের চেয়ে বেশি বিক্রি করে থাকি, তাহলে আপনি ক্রেতা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেটা দেখুন। রেকর্ড বা নামজারি অনুসারে আমার জায়গার পরিমাণ হচ্ছে ৯ শতাংশ; কিন্তু আমি দলিলে আমার জায়গার পরিমাণ উল্লেখ করলাম ১০ শতাংশ। আপনি আমার জায়গা ক্রয় করার পর আপনি যখন দলিল নিয়ে নামজারি করাতে ভূমি অফিসে যাবেন, তখন আপনি সর্বোচ্চ ৯ শতাংশই নামজারি করাতে পারবেন; এক চুলও বেশি নয়। যদিও এখন খাজনা দাখিলা / করের কাগজপত্র জমা দিয়ে জমি বিক্রয় করতে হয় বলে এই সমস্যাটা কমেছে কিন্তু পূর্বের অজস্র দলিলে রেকর্ডের চেয়ে পরিমাণে বেশি জমি বিক্রয় করা হয়েছে। এতে ক্রেতা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনে রাখবেন, দলিলে আপনি কতটুকু মালিক, তারচেয়েও বেশি জরুরী জানা আপনি রেকর্ডে কতটুকু মালিক হতে পারছেন? আপনি ততটুকু জমির মালিক যতটুকু আপনি রেকর্ড বা নামজারি করাতে পারছেন এবং সেই অনুসারে খাজনা বা কর দিতে পারছেন; ততটুকু নন যতটুকু আপনি দলিল সূত্রে পেয়েছেন।

অতীতে যেহেতু খাজনা দাখিল / করের রসীদ জমা না দিয়েই জমি হস্তান্তর (ক্রয়- বিক্রয়) করা যেত, তাই অনেকেই রেকর্ড না দেখেই জমি ক্রয় করে ফেলত। পরে নিজ নামে যখন নামজারি করাতে যেত, তখন দেখত বিক্রেতার নামে ততটুকু জায়গা রেকর্ডে নেই। সেটা কি কি কারণে হতে পারে, সেটা নিয়ে অন্য আরেকটা আর্টিকেল লিখবো। আজ শুধু বলবো এমন ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতাদের করণীয় কি?
ধরুন ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা ৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন, বিক্রেতা প্রকৃতপক্ষে রেকর্ড বা নামজারি অনুসারে ৪ শতাংশ জমির মালিক। এক্ষেত্রে ক্রেতা ৪ শতাংশই নামজারি করাতে পারবে। এখন যেহেতু ক্রেতা বিক্রেতাকে ৫ শতাংশ জমির মূল্যই দিয়েছে, সেহেতু ক্রেতা চাইলে বিক্রেতার কাছ থেকে বাকী ১ শতাংশ জমির মূল্য দাবি করে আদায় করতে পারে। এর জন্য দেওয়ানি এবং ফৌজদারি যেকোনো অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। তবে, বিক্রেতা বাকী ১ শতাংশের মূল্য ফেরত দিলে পূর্বের দলিল সংশোধন করে নেওয়া উচিত।

আবার, ক্রেতা যদি মূল্য ফেরত নিতে সম্মত না হয় (অনেক সময় জমির অবস্থান বা মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্রেতা অসম্মত হতেই পারে) তাহলে ঐ খতিয়ানে (বা ক্ষেত্র বিশেষে বিক্রেতার অন্য খতিয়ানেও) যদি বিক্রেতার অন্য কোন দাগে জায়গা থাকে তাহলে সেখান থেকেও খারিজ/নামজারি করিয়ে নিতে পারে।
যদিও এখন খাজনা বা করের রসীদ দেখিয়ে তারপর জমি ক্রয় বিক্রয় করতে হয়, তারপরও একটি জমি কেনার সময় জমির বিক্রেতার নামে কতটুকু জায়গা রেকর্ড বা নামজারি করানো আছে, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখা ভালো। এতে আপনি ক্রয় করার সময় পরিমাণ নিয়ে অন্তত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আবার, জমি ক্রয় করার সাথে সাথে নামজারির জন্য আবেদন করে ফেলবেন, কখনো নামজারির জন্য অবহেলা করবেন না। মনে রাখবেন, দলিল কেবল আপনার সাথে আপনার বিক্রেতার একটি চুক্তি আর নামজারি হচ্ছে সরকারি বালামে আপনার মালিকার চূড়ান্ত প্রমাণ।

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.