দলিল বাতিল

দলিল বাতিল – কি, কেন, কিভাবে?

জমি-জমার আইন

শফিক এবং রফিক দুই ভাই। শফিক অর্থ উপার্জনের তাগিদে প্রবাসে অবস্থান করছে এবং পরিবারের খরচ মাস শেষে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে। অন্য দিকে, রফিক গ্রামে বাবা মায়ের সাথে অবস্থান করে। বাবা মায়ের দেখভাল করার পাশাপাশি রফিক বাবা মায়ের নিকট বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং নির্ভরশীল অবলম্বন হয়ে উঠে। যেহেতু, শফিক অর্থ উপার্জন করছে এবং রফিক বাবা মায়ের দেখভাল করার দরুন নিজে আলাদা উপার্জন করতে পারলো না, তাই রফিকের উপর বাবা মায়ের একটা বাড়তি দুর্বলতা তৈরি হয়। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল – শফিক মাস শেষে টাকা পাঠালেও সকাল সন্ধ্যা চোখ মেললেই তো রফিককে দেখা যায়, বিপদে আপদে রফিকই তো তাদের ভরসা। রফিক যখন তার বাবা মায়ের এই নির্ভরশীলতাকে দুর্বলতা ভাবতে শুরু করলো তখনি শয়তান তার কাঁধে ভর করলো। আর, বাবা মায়ের যত সম্পত্তি ছিল তার সবটুকু আরেক ভাই শফিককে বাদ দিয়ে সব নিজের নামে লিখিয়ে নিতে বিন্দু মাত্র কার্পণ্য করল না রফিক। বাবা মাও ঝোকের মাথায় সব সম্পত্তি রফিকের নামে দেওয়ার পর বুঝতে পারলো বিষয়টি ঠিক হয়নি। মুসলিম ফরায়েজ অনুসারে, এক ছেলেকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করে সকল সম্পত্তি আরেক ছেলের নামে লিখে দেওয়ায় বিষয়টি অন্যায় হয়েছে বুঝা মাত্র যখন রফিককে বলল, ঐ দলিলটি বাতিল বা সংশোধন করার জন্য তখন রফিক ক্ষেপে গেলো। যখন দলিল সংশোধন করতেও রফিক রাজি হচ্ছিল না, তখন বাবা মা সিদ্ধান্ত নিল ঐ দলিল বাতিল করে ফেলবে। কেননা সম্পত্তির লোভে রফিক এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল যে, বাবা মায়ের কাছ থেকে সম্পত্তি পাওয়ার পর বাবা মায়ের জন্যই নাকি থাকার জায়গা নেই। বাবা মাকে যখন তাদেরই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য রফিক তোড়জোড় শুরু করে তখন শফিক দেশে এসে বাবা মায়ের পাশে দাঁড়ায় এবং রফিককে সকল সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া দললটি বাতিলের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়।

 

উপরের ঘটনাটি কাল্পনিক হলেও বাবা মায়ের সম্পত্তি নিয়ে ছেলে মেয়েদের মধ্য এমন ঘটনা অনেক ঘটে থাকে। আপনার আশেপাশেই চোখ খোলা রাখলেই দেখবেন এমন ঘটনা ঘটছে যেখানে আরও অমানবিক ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। বাবা মাকে ভুল বুঝিয়ে, জোর করে, চাপ প্রয়োগ করে, প্রতারণার মাধ্যমে এমনকি জালিয়াতির মাধ্যমেও এমন দলিল তৈরি করা হয়ে থাকে। এক ভাই আরেক ভাইকে বা একজনই বাকি সকলকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে এমন অনেক দলিল করে থাকে। তাছাড়া এক জমি কয়েক জনের কারণে বিক্রি করার সময় বাটপাররা অনেক ধরনের জাল দলিল তৈরি করে থাকেন। এখানে কিছু মতলববাজরা অনেক পুরনো জাল দলিল তৈরি করে অনেকের অনেক জমি দখল করে নিচ্ছে। এইসব জাল দলিলের ইতিহাস বা ঘটনা নিয়ে লিখতে বসলে অনেক পরিবারের হাহাকারে ভরপুর হয়ে যাবে সবই। তাই আজ পটভূমিতে আর জাল দলিল নিয়ে কিছু লিখছি না। শুধু এতটুকুই আজকের আলোচ্য বিষয় যে, কিভাবে একটি দলিল বাতিল করবেন । আপনি কখন একটি দলিল বাতিল করতে পারবেন আসুন সেটা জানি,

  • একটি দলিল যখন বাতিল প্রকৃতির বা বাতিল যোগ্য তখন ঐ দলিলটি বাতিলের জন্য আপনি আবেদন করতে পারবেন।
  • একটি দলিল বাতিল না হলে বাদী হিসেবে আপনার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
  • একটি দলিল বাতিল করা হলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বা ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত চাইলে একটি দলিল বাতিলের ঘোষণা দিতে সক্ষম।

সর্বোপরি, যদি আপনার আশংকা থাকে যে, কোন দলিল যদি অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা কোন গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে, এখন আপনি ঐ দলিল বাতিলের জন্য মামলা করতে পারবেন এবং যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উক্ত দলিল বাতিল করা সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দলিল বাতিলের মামলা কে দায়ের করতে পারবে । আমরা দলিল সংশোধনের মামলায় দেখেছি যে, দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করতে পারেন কেবলমাত্র দলিলের পক্ষ বা তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বৈধ প্রতিনিধি। কিন্তু, দলিল বাতিলের মামলা দায়ের করতে পারবেন দলিলের পক্ষ, যার বিরুদ্ধে দলিলটি বাতিল বা বাতিল যোগ্য, অথবা যে ব্যক্তি উক্ত বাতিল বা বাতিল যোগ্য দলিলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত।
এখান থেকেই স্পষ্ট যে, দলিল বাতিল করার জন্য আপনাকে দলিলের পক্ষ হওয়ার প্রয়োজন নাই। যেকোনো দলিল যদি কোন ভাবে আপনার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেটা অবশ্যই বাতিল বা বাতিল যোগ্য হতে হবে; তাহলে আপনি সেই দলিল বাতিলের মামলা করে উক্ত দলিল বাতিল করা সম্ভব।

দলিল সংশোধনের মামলার তামাদি মেয়াদ সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই জেনেছি। দলিল বাতিলের মামলার তামাদি মেয়াদ তামাদি আইনের ৯১ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩ বছর।

তবে এখানে মনে রাখার মত আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কোন দলিল বাতিল করার পাশাপাশি দলিলটি বাতিল ঘোষণার জন্য এবং দলিলটি বাদীর উপর বাধ্যকর নয় মর্মে ঘোষণার জন্য,
দলিল বাতিলের মামলার পাশাপাশি ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করতে হবে। ঘোষণামূলক মোকদ্দমার তামাদি মেয়াদ তামাদি আইনের ৯২ ও ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩ বছর।

দলিল সংশোধনের মামলা করার জন্য আপনাকে যেমন দলিলের পক্ষ হওয়ার প্রয়োজন নেই, তেমন দলিল বাতিলের মামলায় বাতিলের আদেশ দেওয়া আদালতের একটি স্বেচ্ছাধীন বা বিবেচনামূলক ক্ষমতা। আদালত চাইলে, কোন দলিলের আংশিক বাতিল করতে পারবেন, আবার চাইলে আংশিক বহালও রাখতে পারবেন। মজার বিষয় হচ্ছে, আদালত চাইলে কোন দলিল বাতিলের আদেশ দেওয়ার পাশাপাশি ন্যায় বিচারের প্রয়োজনে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য ও নির্দেশ দিতে পারেন। অর্থাৎ, কোন দলিল বাতিলের ফলে যদি কোন পক্ষ সরল বিশ্বাসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

আর, দলিল বাতিলের মামলার কোর্ট ফি হচ্ছে এডভেলোরাম কোর্ট ফি। নিচে ছকে এক নজরে দলিল বাতিলের খুঁটিনাটি:

কি ধরনের দলিল বাতিল করা যায়? ১/ যে দলিলটি বাতিল বা বাতিলযোগ্য।

২/ যে দলিল বাতিল না হলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।

৩/ ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত কর্তৃক দলিলটি বাতিল ঘোষণার সক্ষম।

কে কে দলিল বাতিলের মামলা করতে পারে? ১/ দলিলের পক্ষ।

২/ দলিলটি যার বিরুদ্ধে বাতিল বা বাতিলযোগ্য

৩/ বাতিল বা বাতিলযোগ্য দলিলের জন্য যে ক্ষতিগ্রস্থ।

তামাদি মেয়াদ? তামাদি আইনের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩ বছর।
মামলা কোন ধারায় করতে হবে? দলিল বাতিলের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ৩৯ ধারা এবং প্রাসঙ্গিক হলে ৪২ ধারা।
close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.