হেবা দলিল বাতিল

হেবা দলিল বাতিল করবেন কিভাবে?

জমি-জমার আইন

নুহুল হক সাহেবের বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ওনাকে কবর দেওয়া নিয়ে বেশ বিলম্ব হয়। কেননা, ওনার মৃত্যুর পর ওনার সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে ওনার ছেলেদের মধ্যে বিরোধ লেগে যাওয়ার কারণে তারা সম্পত্তির সুষম বণ্টনের পূর্বে তাকে কবরস্থ করতে রাজি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা বিলম্বের পর ঐ এলাকার স্থানীয় সরকার এসে সম্পত্তির সঠিক বণ্টনের আশ্বাস প্রদান করার পর নুহুল হক সাহেবের বড় ভাইয়ের জানাজা শেষে কবরস্থ করা হয়।
এমন মর্মান্তিক ঘটনা দেখার পর নুহুল হক সাহেব চিন্তা করলেন ওনার মৃত্যুর পর ওনার ছেলে মেয়েদের মধ্যেও যদি একই ধরনের সমস্যার জন্ম নেয়, তাহলে তো আর দেখতে হবে না। তাই, তিনি সকল ছেলেমেয়েকে ডেকে যার যার হিস্যা বা অংশ অনুযায়ী সম্পত্তি হেবা করে দিয়েছেন।

নুরুল হক সাহেব ‘জ্বলন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় ঝাপ দিলেন’। সম্পত্তি নিয়ে ছেলেমেয়েদের কামড়াকামড়ি ওনার ভাই অন্তত জীবিত অবস্থায় দেখেনি বা লাশ হওয়ার পর তিনি সন্তানদের অবজ্ঞার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু নুরুল হক সাহেব তো জীবিত অবস্থাতেই সন্তানদের অবজ্ঞার শিকার হচ্ছেন। তিনি নিজের মৃত্যুর পর সন্তানরা যাতে ওনার লাশ সামনে রেখে ঝগড়া বিবাদ না করে বা লাশকে অবজ্ঞা না করে তার জন্য জীবিত অবস্থায় হেবার বন্দোবস্ত করেছিলেন, অথচ সন্তানরা সম্পত্তি বুঝে পাওয়ার পর কেউই বাবার উপর সন্তুষ্ট না। কেউ বলে ওর সম্পত্তির মূল্য বেশি, কেউ বলে ওর জন্য বাবা অনেক টাকা খরচ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

যে সম্পত্তি কিছু দিন আগেও ওনার নিজের ছিল, এখন সেই সম্পত্তি নিয়ে ওনার সন্তানদের মাঝে কত যত্ন, কত রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু, যতদিন ওনার মালিকানায় ছিলো, তখন কারো কোন মাথা ব্যথা ছিল না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, নুরুল হক সাহেবের সম্পত্তি সন্তানদের মালিকানায় যাওয়ার সাথে সাথেই তিনি নিজেই উক্ত সম্পত্তিতে বোঝা হয়ে গেছেন। সবার জায়গা হলেও নুরুল হক সাহেব আর ওনার স্ত্রীর জায়গা হচ্ছে না ঐ সম্পত্তিতে। ওনাদের খাবার দাবারেও কারো আগের মত যত্ন নেই। নুরুল হক সাহেব মৃত্যুর পরের ঝামেলা এড়াতে গিয়ে এখন নিজের জীবদ্দশাতেই অবহেলার শিকার হচ্ছেন দেখে অনেকেই বুদ্ধি দিচ্ছেন যাতে তিনি ওনার হেবা দলিলটি বাতিল করে নিজের সম্পত্তি নিজের করে নেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হেবা দলিল বাতিল করা সম্ভব হবে কিনা?

 

আমরা জানি যে, কোন মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা সম্পত্তির হেবার জন্য প্রধানত তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। যেগুলো হচ্ছে,

  • দাতা কর্তৃক হেবার ঘোষণা,
  • গ্রহীতা কর্তৃক হেবা গ্রহণ এবং
  • দাতার দ্বারা দখল হস্তান্তর এবং গ্রহীতা কর্তৃক দখল গ্রহণ।

 

এখানে দাতা হেবার ঘোষণা যেমন করতে হবে, তেমনি গ্রহীতাকে হেবা গ্রহণ করতে হবে। এরপরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দখল হস্তান্তর করতে হবে। দখল হস্তান্তর ব্যতীত হেবা সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয় না।
আবার, মুসলিম আইন অনুসারে হেবা করার জন্য হেবার দাতার যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,

  • হেবা দাতাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। 
  • অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স্ক হতে হবে। যারা লিগ্যাল অভিভাবকের অভিভাবকত্বের মধ্যে বড় হয়েছে তাদেরকে ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে। 
  • দাতাকে অবশ্যই জেনে শুনে পূর্ণ সম্মতিতে হেবা করতে হবে। 
  • হেবার ক্ষেত্রে দাতা গ্রহীতার মাঝে কোন প্রকার বিনিময় থাকতে পারবে না। 
  • দাতাকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। 
  • দাতাকে অবশ্যই প্রকৃতিস্থ হতে হবে, পাগল কেউ হেবা করতে পারবে না। 
  • দাতাকে দেউলিয়া হলে চলবে না। 
  • দাতার অবশ্যই সম্পত্তিতে বৈধ মালিকানা থাকতে হবে।

এখন হেবা দলিল করার জন্য যেসব শর্ত বা উপাদান রয়েছে, তার মধ্যে যদি প্রতারণামূলক ভাবে কোনটি অনুপস্থিত বা অসম্পূর্ণ থাকে অথবা পুরো হেবা দলিলটিই প্রতারণার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে, তাহলে উক্ত হেবা দলিলটি বাতিল করা যেতে পারে।
যেমন, উপরের ঘটনা নুরুল হক সাহেব বা যেকোনো দাতা অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় বা পূর্ণ সম্মতি ব্যতিরেকে বা বিনিময় নিয়ে বা অসুস্থ থাকাবস্থায় বা অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় বা দেউলিয়া অবস্থায় বা বৈধ মালিকানা না থাকাবস্থায় যদি কাউকে কোন সম্পত্তি হেবা করে থাকে, তাহলে উক্ত হেবা বাতিল করা যেতে পারে। আর দাতা যদি দখল হস্তান্তর না করে তাহলেও উক্ত হেবা বাতিল করা সম্ভব হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হেবা দলিল বাতিল করা যাবে কিভাবে?
মুখের কথায় বা গায়ের জোরে হেবা দলিল বাতিল করা যায় না, যাবে না। হেবা দলিল বাতিল করতে হবে আদালতের মাধ্যমে। আদালতে দলিল বাতিলের জন্য মামলা দায়ের করলে, আদালত মামলার বিষয়বস্তুর গুনগত মান বিবেচনা করে যৌক্তিক মনে করলে উক্ত হেবা দলিল বাতিল করতে পারেন।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে একটি লিখিত দলিল বাতিল বা বাতিল যোগ্য, যার যুক্তিসঙ্গত আশংকা আছে যে, এই জাতীয় লিখিত দলিল থেকে গেলে তা তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে, তাহলে তিনি উক্ত লিখিত দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণা চেয়ে মামলা করতে পারেন। উক্ত মামলার ভিত্তিতে আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে তেমন রায় প্রদান করতে পারেন; চুক্তি বিতরিত এবং বাতিল করার আদেশ দিতে পারেন।

আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে আদালত যদি মনে করেন যে, উক্ত দলিল বাদীর জন্য ক্ষতিকর এবং প্রকৃতই প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত দলিল সম্পাদন বা রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, তাহলে দলিল বাতিলের আদেশ দিতে পারেন। আর যদি মনে হয় যে, শুধুমাত্র হয়রানি করার উদ্দেশ্য বা প্রতারণার কিছুই ছিল না এখানে, তাহলে দলিল বাতিলের আদেশ দিবেন না। এখানে আদালতের পুরো ক্ষমতাই হচ্ছে ইচ্ছাধীন, আদালতকে বাধ্য করা যাবে না কোন নির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়ার জন্য।

আর দলিলটি যদি রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর অধীনে নিবন্ধিত হয়ে থাকে, তাহলে আদালত তার ডিক্রির একটি অনুলিপি যে অফিসারের অফিসে নিবন্ধিত হয়েছে তার কাছে পাঠাবে এবং এই ধরনের কর্মকর্তা তার বইয়ে থাকা দলিলের অনুলিপিতে এটি বাতিলের সত্যতা নোট করবেন। অর্থাৎ, যদি কোন হেবা দলিল আদালত বাতিল ঘোষণা করে তাহলে যে সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে নিবন্ধন করা হয়েছিল, সেই সাব রেজিস্ট্রি অফিসে উক্ত রায়ের একটি কপি পাঠাবেন, যাতে বালাম বইতে উক্ত দলিল সম্বন্ধে আদালতের রায় সম্পর্কিত তথ্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে।

এভাবেই একটি হেবা দলিল বাতিল করা যেতে পারে। তবে উল্লেখ্য, হেবা দলিল কার্যকর হওয়ার পর যদি হেবা দলিলের দাতা কিংবা গ্রহীতা যেকোনো একজনও যদি মারা যায়, তবে হেবা দলিল আর বাতিল করা সম্ভব নয়। হেবা দলিল বাতিল করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার হচ্ছে আদালতের, যদি কেউ আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে, তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিতেই আদালত হেবা দলিল বাতিল করতে পারেন। তাই, নিজ জীবদ্দশায় হেবা করার পূর্বে অতীব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এজন্যই মুরুব্বীরা বারংবার বলে গিয়েছিলেন যে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.