একই সম্পত্তি বাহিরে বিক্রির এবং পরে গোপনে সন্তানকে হেবা

বিক্রির পরে হেবা করলে করণীয়

শফিক সাহেব ২০০০ সালে উনারই নিজ বন্ধু করিম সাহেবের কাছে নিজ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় তিন কাঠা জমি বিক্রি করেন। যে দাগের ৩ কাঠা জমি বিক্রি করেছিলেন সেটাতে ওনার আরও ৭ কাঠা জমি ছিল। অর্থাৎ ১০ কাঠা জমির মধ্যে তিনি ৩ কাঠা জমি বিক্রি করেছিলেন।

কিন্তু, পরবর্তীতে তিনি কি মনে করে ২০১০ সালে ১০ কাঠা সম্পত্তির পুরোটাই নিজ ছেলে সায়মনকে হেবা করে দেন। ওইদিকে করিম সাহেব ২০০০ সালে জমি ক্রয় করলেও তিনি নামজারি বা জমা খারিজ করায়নি। তখন জমির দলিলেই বেশি আস্থা বা প্রচলন ছিল, নামজারির আবেদন করতে প্রায় সবাইই বিলম্ব করতো।

কিন্তু সায়মনকে ১০ কাঠা সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পরে শফিক সাহেব পুরো সম্পত্তিটাই সাইমনের নামে নামজারি করিয়ে নেন। এরপর আরও ১০ বছর কেটে যায় এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে শফিক সাহেব মৃত্যুবরণ করেন।
করোনার সময় রফিক সাহেবও গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন এবং শফিক সাহেবের মৃত্যুর পর তিনি ঐ জায়গা সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময় গুলোতে সরকার নামজারি করার জন্য বেশ তাগিদ দেওয়া এবং প্রচারণা করার কারণে রফিক সাহেব ওই সম্পত্তিটি নামজারি করার জন্য আবেদন করেন।

উল্লেখ্য, বলে রাখা ভালো রফিক সাহেব শহরে বসবাস করেন আর জমিটি ছিল গ্রামে। গ্রামের নিয়মিত যাতায়াত ছিল না বলে তিনি এত বছর জমিটি সম্বন্ধে কোন খোঁজ খবর রাখেননি। শুধু ২০০০ সালে ক্রয় সূত্রে যে দলিলটি করেছিলেন, সেই দলিলটি ছাড়া ওনার কাছে আর কোন ধরনের কাগজপত্রও নেই।

শফিক সাহেব যে ছেলের নামে হেবা দলিল করে পরবর্তীতে নামজারি করে সম্পূর্ণ সম্পত্তি অর্থাৎ ১০ কাঠা সম্পত্তি ছেলের নামে পাকাপোক্ত করিয়ে নিয়েছেন, এ বিষয়ে রফিক সাহেব যেমন জানতেন না, তেমনি শফিক সাহেবের ছেলে সায়মন কিংবা ওনার পরিবারের কেউই ২০০০ সালের ঐ বিক্রি সম্বন্ধে জানতে না।

এখন শফিক সাহেব জীবিত নেই আবার রফিক সাহেব নামজারীর জন্য আবেদন করেছেন। এমতাবস্থায় ভূমি অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে, উক্ত জমি শফিক সাহেবের ছেলে সাইমনের নামে নামজারি করা আছে, তাই রফিক সাহেবের আবেদন নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় রফিক সাহেব শফিক সাহেবের অবর্তমানে সাইমনের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সায়মনকে পুরো বিষয়টি খুলে জানেন।
শফিক সাহেব কোন মতলবে বা কোন উদ্দেশ্যে একই জমি নিজের বন্ধুর কাছে বিক্রি করার পরে আবার নিজের ছেলের কাছে হেবা করে দিয়েছেন, সেটি সায়মনের জানা নেই। কিন্তু, তার মৃত বাবাকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করুক বা চিটার বাটপার বলুক সেই সুযোগ সায়মন দিতে চায়নি।

তাছাড়া, রফিক সাহেবের দলিল দেখে যখন বৈধ এবং জাল নয় বলে নিশ্চিত হলো, তখন সায়মন চায়নি অন্যায় ভাবে ওই ৩ কাঠা জমি ভোগ করতে। তাই সে রফিক সাহেবকে ওই দিন কাটা জমি ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছা পোষণ করে।
কিন্তু স্থানীয় দলিল লেখকের কাছ থেকে সায়মন জানতে পারলো যে, যদি এখন সায়মন ৩ কাঠা সম্পত্তি লিখে দেয়, সেই ক্ষেত্রে পূর্বে তার বাবা শফিক সাহেব রফিক সাহেবকে ২০০০ সালে যে দলিল করে দিয়েছিলেন, সেই দলিলমূলে বা ঐ দলিল দেখিয়ে তিনি পুনরায় আরও ৩ কাঠা সম্পত্তি দাবি করতে পারবেন।

অর্থাৎ সায়মনের বাবা রফিক সাহেবকে ৩ কাটা সম্পত্তি দিয়েছেন এবং সায়মনও পুনরায় ৩ কাঠা সম্পত্তি দিচ্ছে, যার ফলে রফিক সাহেব একই দাগে একসাথে ৬ কাটা সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করছেন; অন্তত দলিল মূলে। এখন সায়মন তার বাবাকে ছোট করতে চায় না কিংবা পরকালীন চিন্তা মাথায় রেখে রফিক সাহেবকে কিভাবে ৩ কাটা সম্পত্তি বুঝিয়ে দিবে?

 

প্রথমত, শফিক সাহেব রফিক সাহেবকে যে ৩ কাঠা সম্পত্তি বিক্রি করেছেন, সেই দলিলটি এখনো বৈধ; যদিও তিনি নামজারির আবেদন করেননি তখনকার সময়। কিন্তু একই বিক্রেতা যদি একই সম্পত্তি ভিন্ন ভিন্ন বিক্রেতার কাছে একের অধিকবার বিক্রি করে, সেক্ষেত্রে প্রথম দলিলটি বৈধতা পারে আর পরের গুলো বৈধতা পাবে না। তবে, পরবর্তী দলিলের গ্রাহকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।
এখন শফিক সাহেব যেহেতু রফিক সাহেবের কাছে ৩ কাঠা জমি বিক্রির বিষয়টি গোপন রেখে নিজ ছেলের কাছে হেবা করে সেটি নামজারি করে ফেলেছেন, সেক্ষেত্রে সায়মন যদি ভূমি অফিসে গিয়ে রফিক সাহেবের নামজারির আবেদনটির বিষয়ে মধ্যস্থতা করে, সেক্ষেত্রে ভূমি অফিস যদি নিজস্ব এখতিয়ার বলে সায়মনের ১০ কাঠা থেকে রফিক সাহেবের নামে ৩ কাঠা কেটে নামজারি করিয়ে দেয়, তাহলে খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে।

কেননা, টেকনিক্যালি এবং প্র্যাকটিকালি যদি রফিক সাহেব আগে নামজারির আবেদন করবেন এবং পরে শফিক সাহেব তার ছেলেকে ১০ কাঠার দলিল করে দিলেও দাগে ৭ কাঠা অবশিষ্ট থাকার কারণে সায়মনের নামে কেবল ৭ কাঠাই নামজারি হতো। সেই হিসেবে ভূমি অফিসকে যদি সায়মন কনভিন্স করতে পারে আর ভূমি অফিস নিজ এখতিয়ারে করতে পারে, তাহলে উক্ত বিরোধ এখানেই শেষ।

দ্বিতীয়ত, প্রথম উপায় অনুযায়ী যদি ভূমি অফিস উক্ত নামজারিতে অপারগতা জানায়, সেক্ষেত্রে সায়মনকে নতুন করে রফিক সাহেবের নামে ৩ কাঠা সম্পত্তি লিখে দিতে হবে। কিন্তু রফিক সাহেব যদি কখনো ২০০০ সালে শফিক সাহেব উনাকে যে সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন সেই দলিলটি দিয়ে সম্পত্তি দাবি করে সেই ক্ষেত্রে সায়মন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় সায়মনের উচিত হবে প্রথমে রফিক সাহেবের কাছে যে দলিলটি রয়েছে সেই দলিলটি বাতিল করা। সায়মন রফিক সাহেবকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, উক্ত দলিল বাতিল হওয়ার সাথে সাথেই নতুন দলিল করে ৩ কাঠা জমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
উভয় পক্ষ আদালতের মাধ্যমে ২০০০ সালের শফিক সাহেব রফিক সাহেবকে যে দলিল করে দিয়েছিলেন সেই দলিলটি বাতিল করার পর সায়মন পুনরায় ৩ কাটা সম্পত্তি রফিক সাহেবকে লিখে দিলে উক্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে রফিক সাহেব যেমন ন্যায্য ৩ কাঠা সম্পত্তি খুঁজে পাবেন ঠিক তেমনি রফিক সাহেব ভবিষ্যতে ৩ কাঠার পরিবর্তে ৬ কাটার সম্পত্তি অর্থাৎ ২০০০ সালের দলিল মোতাবেক আরো ৩ কাঠা সম্পত্তি দাবি করতে পারবে না। যার ফলশ্রুতিতে সায়মন নিজেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সবাই তো সায়মনের মত নিজ দায়িত্বে এভাবে সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না, উল্টো বাবা বিক্রি করে গেলে সন্তান এসে দখল বুঝিয়ে দিতে চায় না, সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতার করণীয় কি?- আজকের পর্ব ইতিমধ্যে অনেক বড় হয়ে গেছে। এই সম্বন্ধে ইনশাআল্লাহ্‌ পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা করা যাবে।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়