এজমালি সম্পত্তি থেকে ঝামেলাহীন উপায়ে নামজারি

নামজারি এজমালি

আমাদের সমাজে জমি জমা নিয়ে যত ঝামেলা রয়েছে, তার প্রায় বেশির ভাগই উদ্ভব হয় পরিবার থেকে। পারিবারিক মিল বন্ধনের অভাবে দেখা যায় যে, কেউ কাউকে ছাড় দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো একে অন্যের থেকে কিভাবে বেশি আদায় করবে সেই চিন্তায় থাকে। সেই হিসেবে আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হচ্ছে, আমাদের মা বোনেরা। অনেকেই আছে, অনেক ধর্ম কর্ম করে কিন্তু নারীদের সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে বেশ উদাসীন। বিশেষ করে বোন আর ফুফুর ক্ষেত্রে। অনেকেই বিভিন্ন চাপে পড়ে দিতে চাইলেও দেখা যায় যে, একদম কম দামী জায়গাটি দেওয়ার মতলব করে। যেমন, বাড়ির ভেতরে বাগান বা আঙিনা যে জমি একজন বোনের প্রয়োজন নেই, কেননা সে থাকবে স্বামীর বাড়ি।

আবার, সবাই যে দিতে চায় না তাও না। অনেক সময় অনেক ভাই বা ভাইয়ের ছেলেরা দিতে চাইলেও বাকি অংশীদারদের চাপে পড়ে চুপ থাকতে বাধ্য হয়। এমন কুসংস্কারও আছে যে, বাবার বাড়ির সম্পত্তি স্বামী বাড়িতে নিয়ে আসলে সেটি কোন না কোন অমঙ্গল বয়ে আনে; ভাবা যায় আজকে দিনে এখনো এমন কথা গ্রামে শুনতে পাওয়া যায়। আমাদের মা বোনেরা বিয়ের পর যখন স্বামীর সংসারে চলে যায়, তখন বাবা মায়ের সম্পত্তিতে তাদের যে হক বা অধিকার রয়েছে, সেটি পরিপূর্ণ ভাবে আদায় করা তো দূরে থাক, তাদের হক বা অধিকার তথা সম্পত্তির পরিমাণ কতটুকু সেটিও সঠিক ভাবে জানতে পারে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এমন অনেককে জানি, যারা তাদের বাবার অবর্তমানে ভাই বা ভাইয়ের ছেলেদের কাছে গিয়ে তাদের পাওনা সম্পত্তি আদায়ের জন্য যদি জমি জমার দুই একটা কাগজপত্র চাওয়া হয়, তারা এমন আচরণ করে তখন বাধ্য হয়ে অনেকেই ‘ভিক্ষা লাগবে না মা তোর, কুত্তা সামলা’ অবস্থা হয়ে যায়। মা বোনেরা তাদের প্রিয় ছোট বেলাটা যে বাড়িতে কাটিয়েছে, সেই বাড়ি ছেড়ে সারাজীবনের জন্য স্বামীর বাড়ি চলে যায়। অথচ, মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি যদি বেড়াতে আসতে না পারে, তাহলে তো নিজের স্বামীর বাড়িতেই অসম্মান হতে হয় বা ছোট হতে হয়। সম্পত্তির দাবী করলে যদি বাবার বাড়িতে আসাই বন্ধ হয়ে যায়, সেই লজ্জায় অনেকেই চুপ হয়ে যায় বাধ্য হয়ে। এমন ঘটনা অনেকের কাছে কাল্পনিক হলেও একটু গ্রাম গঞ্জে গিয়ে কান পাতলেই শুনতে পারবেন। কিন্তু, সবার আর্থিক অবস্থা এক রকম থাকে না। অনেকেই স্বামীর আর্থিক অচলাবস্থার জন্য বাধ্য হয়ে, বাবার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে নিজের স্বামী সন্তানের অবস্থার পরিবর্তন করাতে চায়। তখনি শুরু হয়, লঙ্কা কাণ্ড।

 

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, এজমালি বা যৌথ সম্পত্তির মধ্য থেকে নিজেদের মধ্যে আপোষ বণ্টন করে নিজেদের ইচ্ছে মত সবাই সবাইকে কিছুটা ছাড় দিয়ে একটু সাজিয়ে বণ্টন দলিল প্রস্তুত করলে সেটি স্থানীয় সাব- রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন করে করে নিজ নিজ নামে নামজারি করে নিজেদের সম্পত্তি নিজেরা বুঝে নিতে পারেন। তবে, সবাই তো আর সহজেই বা আপোষেই সম্পত্তি বণ্টন করে রাজি নয় না। তখন, বাধ্য হয়ে যেতে হয় বাটোয়ারা মামলায়। কিন্তু, আমরা জানি বাটোয়ারা মামলা করলে এই মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, যার ফলে বাটোয়ারা মামলা করতে যারা সম্পত্তির সুষম বণ্টন চায় না, তারা সেখানে গিয়েও মামলার দীর্ঘ সূত্রটার জন্য যা যা করণীয়, তার সবকটি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। যার জন্য ভিকটিমরা মামলার পিছনে ছুটতে ছুটতে একসময় হাল ছেড়ে দেয়। তাই, আপোষ বণ্টনে ব্যর্থ হলে বাটোয়ারা মামলা না করে সবচেয়ে ভালো হয়, সরাসরি নিজ নামে নামজারির আবেদন করা। এই প্রক্রিয়াটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তাও কিন্তু না। তবে, আপোষ বণ্টন দলিল বা বাটোয়ারা দলিল ছাড়া শুধু নিজ হিস্যা অনুযায়ী নামজারি করতে ভূমি অফিসে আবেদন করা যেতে পারে। এতে এসি ল্যান্স বা তহসিলদার যদি নামজারির অনুমতি দেয়, তাহলে কিন্তু আপনি আপোষ বণ্টন দলিল বা বাটোয়ারা দলিল ছাড়াই নিজ নামে নামজারি করে নিজের সম্পত্তি বুঝে নিতে পারেন।

আবার, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বোন বা ফুফুদেরকে অর্থাৎ নারী উত্তরাধিকারদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য ভূমি জরীপ/ ল্যান্ড সার্ভে করার সময় বোন বা ফুফুদের নাম এজমালি বা যৌথ সম্পত্তির যৌথ খতিয়ানেই উল্লেখ করে না। আবার, এ ধরনের যৌথ খতিয়ান লুকিয়েও রাখা হয় অনেক সময়। তখন আসলে কি করার আছে আমাদের মা বোনদের?
আপনাদের কাজ হচ্ছে, প্রথমেই ঐ যৌথ খতিয়ান সংগ্রহ করা। এর জন্য প্রথমে আপনাদের সম্পত্তি যে এলাকায় সেই এলাকার ভূমি অফিসে যাবেন এবং নিজেদের নাম দিয়ে বা আপনার মা/বাবার নাম দিয়ে বা আপনাদের এলাকার জমির যে দাগ নাম্বার রয়েছে সেই নাম্বার দিয়ে খতিয়ান তল্লাশি দিবেন। এতেই খতিয়ান পেয়ে যাবেন আশা করি। খতিয়ান পাওয়ার পর যদি আপনারা আপনাদের নাম খতিয়ানে পেয়ে যান এবং হিস্যা ঠিক থাকে, তাহলে উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী, এসি ল্যান্স বা তহসিলদারের অফিসে যদি নামজারির আবেদন করেন, তাহলে ‘হয়তো’ আপনি আপোষ বণ্টন দলিল বা বাটোয়ারা দলিল ছাড়াই এজমালি বা যৌথ সম্পত্তির মধ্য থেকে নিজের সম্পত্তি তথা যৌথ খতিয়ান থেকে নিজ নামে নামজারি করে নতুন খতিয়ান প্রস্তুতের মাধ্যমে নিজের সম্পত্তি বুঝে নিতে পারেন।

কিন্তু, যদি দেখেন যে, এজমালি বা যৌথ সম্পত্তির মধ্যে তথা যৌথ খতিয়ানে আপনি বা আপনাদের নাম খতিয়ানে না থাকে বা থাকলেও হিস্যার পরিমাণ সঠিক ভাবে না থাকে তাহলে আপনাকে প্রথমে এলএসটি(ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল)’তে মামলা করে খতিয়ান সংশোধন করে তারপর উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী নিজের সম্পত্তি আদায় করে নিতে হবে। ইনশাআল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ আপনার সহায় হবেন।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়