ক্রয়-বিক্রয়ে দলিলে জমির প্রকৃত মূল্য দেখানো উচিত

দলিলে জমির দাম

শুরুটা একটা গাণিতিক প্রশ্ন দিয়ে করি, দেখি তো পারেন কিনা? আমরা সকলেই জানি যে, ইংরেজি সাল গণনা শুরু হয়েছে হযরত ঈসা (আঃ) তথা যিশু খ্রিস্টের জন্মের পর থেকে। যেমনটা আরবি (হিজরি) সাল গণনা শুরু হয়েছে হযরত মোহাম্মদ (সা:) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন তখন থেকে। যেহেতু, যিশু খ্রিস্টের জন্ম থেকে ইংরেজি সাল গণনা শুরু হয়েছে, সেহেতু যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন জানুয়ারির এক তারিখে হওয়ার কথা তাই না? কিন্তু, সেটি না হয়ে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ কেন হল বলতে পারেন?- উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

প্রকৃত শূন্যতা পছন্দ করে না, তাই হয়ত যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে পালন করা হয় না, এইদিকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্মদিন জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ফেসবুকে ঢুকলে দেখা যায় যে, ঐদিন এক তৃতীয়াংশ বন্ধুর জন্মদিন। বড়াই করার কিছু নাই, আমার বাবা চাচার জন্মদিনও জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। সেটি আসলে কেন হয়েছে, তা আমাদের সকলেরই জানা, তাই লিখে শব্দ বাড়াচ্ছি না।

এবার আসি আমাদের জেনারেশনে, আমাদের জন্ম তারিখ নিয়ে সমস্যা না থাকলেও জন্ম সাল নিয়ে রয়েছে বেশি গড়মিল। বেশির ভাগ মানুষ রয়েছে যাদের প্রকৃত জন্ম তারিখ একটি, কিন্তু সার্টিফিকেটে রয়েছে আরেকটি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই সার্টিফিকেটে বয়স কম দেখানোটা পারিবারিক কালচার হয়ে গেছে। যেহেতু ৩০ বছর বয়সের পর চাকরিতে আবেদন করা যায় না সেহেতু সন্তানের বয়স যদি ২/১ বছর কম দেখানো যায়, সে ক্ষেত্রে চাকরির বাজারেও যাতে সে ২/১ বছর বেশি সময় পেতে পারে সেজন্য বয়স কম দেখানো হয়।

আরেকটি সুন্দর গোপনীয়তা রয়েছে, কখনও নারীর বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই আর পুরুষের বেতন জিজ্ঞেস করতে নেই। কেননা জিজ্ঞেস করা হলেও নাকি সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। নারী তার বয়স কমিয়ে বলবে, আর পুরুষ তার বেতন বাড়িয়ে। মজার বিষয় হচ্ছে ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের জমিজমা ক্রয় বিক্রয়ের সময়ও ক্রেতা বিক্রেতা নিজেদের সুবিধা মত জমির মূল্য বাড়িয়ে কমিয়ে লিখাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আজকে আমরা আলোচনা করব, দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম/বেশি দেখালে কি ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন, সেই সম্ভাবনা গুলো নিয়ে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, জমি যে মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে অর্থাৎ সঠিক যে মূল্যে, ঐ মূল্যই জমির দলিলে উল্লেখ করা উচিত; এটি যেমন আইনসম্মত তেমনি ভবিষ্যতে আপনি কোন ধরনের জটিলতায় পড়বেন না।

তাছাড়া, আপনি যদি জমির মূল্য কম উল্লেখ করেন সেক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব কম আদায় হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকার আপনার কাছ থেকে সঠিক রাজস্ব পাচ্ছে না। এই কথা সরকার বিভিন্ন ভাবে জানিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করলেও অপ্রিয় হলেও সত্য কথাটি হচ্ছে, চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রেতা বিক্রেতার নিজের ক্ষতি হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের ক্ষতি বা রাষ্ট্রের ক্ষতি; এরা এটা গ্রাহ্যই করবে না। তাই, আসুন দেখি যদি কেউ জমির প্রকৃত মূল্য গোপন রেখে কম বা বেশি দেখায় তাহলে কে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর কোথায় কোথায় প্রভাব পড়বে।

দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দেখালে দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দেখালে
সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে রাজস্ব আদায় হতে বঞ্চিত হবে। আর, রাষ্ট্র যখন রাজস্ব কম আদায় করতে পারবে, তখন রাষ্ট্র হয়ত এই সেক্টরে ভর্তুকি দিবে নয়ত কোন উন্নয়ন মূলক কাজ করতে ব্যর্থ হবে। সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
জমির মূল্য কম দেখালে ক্রেতা বিক্রেতা দুইজনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যখন ঐ জমি বিক্রির বিরুদ্ধে অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমা করা হয়। আমরা জানি, অগ্রক্রয়ের ক্ষেত্রে দলিলে উল্লেখিত মূল্যকেই জমির প্রকৃত মূল্য ধরা হয় (যদিও সাথে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়)। ফলে নতুন ক্রেতা কিন্তু দলিলে উল্লেখিত মূল্য পরিশোধ করেই জমির মালিকানা অর্জন করে ফেলবেন। ফলে, প্রথম ক্রেতা পড়বেন বিপাকে। যদি বিক্রেতা প্রথম ক্রেতাকে প্রকৃত মূল্য না বুঝিয়ে দেয়, প্রথম ক্রেতা কিভাবে প্রমান করবে যে সে দলিলে উল্লেখিত টাকার চেয়ে বেশি টাকা প্রদান করেছে? জমির মূল্য বেশি দেখালে ২য় ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, জমি বিক্রি হয়েছে ১০ লক্ষ টাকায়, কিন্তু দলিলে উল্লেখ করা ১৫ লক্ষ টাকা; সেক্ষেত্রে ২য় ক্রেতাকে বাড়তি ৫ লক্ষ টাকা গুনতে হয় অগ্রক্রয়ে জমি ক্রয় করতে গেলে। দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দেখানোর এটাই একমাত্র মুখ্য কারন থাকে যাতে অগ্রক্রয়ে অন্য কেউ কিনতে না পারে। অগ্রক্রয় একটি ইসলামিক নিয়ম, সেটিকেও বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে, এর জমির মূল্য বাড়তি দেখিয়ে।
জমির মূল্য কম দেখালে মৌজা রেট বৃদ্ধি পাবে না। পাশাপাশি আশপাশের জমির মূল্যও কাগজে কলমে বৃদ্ধি পাবে না। জমির মূল্য বেশি দেখালে মৌজা রেট অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি আশপাশের জমির মূল্যও কল্পনাতীত ভাবে বৃদ্ধি পাবে, সবাই তাদের জমির মূল্য বৃদ্ধি করে দিবে যা মোটা দাগে সবার উপরই প্রভাব বিস্তার করবে।
দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দেখালে ক্রেতা যে বাড়তি টাকাটা পাচ্ছে, সেটি কিন্তু উৎসহীন। ফলে সেটি কিন্তু কালো টাকা হয়ে গেলো। ক্রেতা তার উৎস দেখাতে না পারলে এই কালো টাকার জন্যই তিনি বেকায়দায় পড়বেন। দলিলে জমির মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দেখালে ক্রেতা সেই বাড়তি টাকাটি কোথায় খরচ করেছে, সেটি কি আদৌ দেখাতে পারবে?

বিষয়টি এখন অনেক হয়ত ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ মনে হচ্ছে, কিন্তু যত একদিন যাচ্ছে ততই কঠিন হবে। আগে জমি বিক্রয়ের সময় ভায়া দলিল হলেই চলতো, এখন খতিয়ান, জমা খারিজ, জাতীয় পরিচয়পত্র, টিন সার্টিফিকেট লাগছে, ভবিষ্যতে টাকা উৎস সংক্রান্ত আরও কঠোরতাও আসতে পারে, তাই স্বচ্ছ প্র্যাকটিস শুরু করা উচিত। কাউকেই ফাঁকি দেওয়া হল না; রাষ্ট্রকেও না।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

খাস জমি কি, কোন গুলো এবং এর ইতিহাস

একই জমি দুইজনের নাম নামজারি থাকলে করনীয় কি?

জোর করে জমি দখল করতে চাইলে করনীয়