বেনামী সম্পত্তি

বেনামী সম্পত্তি ক্রয়ঃ লাভ না ক্ষতি?

জমি-জমার আইন

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এসে থাকে সাধারণত প্রবাসী রেমিটেন্স থেকে এই প্রবাসী ভাইয়েরা যখন বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় বাড়িতে, সেই টাকা দিয়েই তাদের সংসার পরিচালিত হয় পাশাপাশি প্রবাসীরা বিদেশে থাকা অবস্থাতেই কোন জমি ক্রয় করলে দেশে থাকা তার বাবা, ভাই বা স্ত্রীর কাছে টাকা পাঠায় এবং সেই টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করতে বলে। তবে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক প্রবাসী ভাই রয়েছেন যারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছেন তার বাবার কাছে জমি ক্রয়ের জন্য কিন্তু বাবা ওই জমি নিজের নামে ক্রয় করে ফেলেছেন; যেটি আপাতদৃষ্টিতে কোন সমস্যা না হলেও বাবার মৃত্যুর পর ওই জমিতে বাবার সকল ওয়ারিশরা অংশীদার হয়ে যায়। যদিও বা ওই জমি ক্রয়ের সময় পুরো অর্থ বহন করেছিলেন প্রবাসী ছেলে। যদি প্রবাসী ছেলের এতে কোন আপত্তি না থাকে তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই কিন্তু যদি প্রবাসী ছেলের ইনটেনশন থাকে শুধুমাত্র তার নিজের নামে ক্রয় করার জন্য সেই ক্ষেত্রে বাবা তার নিজের নামে ক্রয় করে এই প্রবাসী ছেলেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। এই ক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র বাবাকে দোষারোপ করছি তা কিন্তু নয়, বাস্তব জীবনে দেখা যায় অনেক প্রবাসী তার ভাইকে বা বোনকে বিশ্বাস করে টাকা পাঠায় এমনকি নিজের স্ত্রীকেও বিশ্বাস করে প্রবাস থেকে টাকা পাঠিয়ে স্ত্রী, ভাই-বোনকে জমি ক্রয় করতে বলে। সেই ক্ষেত্রে তারা ওই প্রবাসীর নামে জমি ক্রয় না করে তাদের নিজেদের নামে জমি ক্রয় করে ফেলেন। এখনো পর্যন্ত ধর্মীয় এবং পারিবারিক মূল্যবোধ ও সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস থাকায় ধরুন সেই অর্থে আইনি জটিলতা এখনো পর্যন্ত তৈরি হয়নি বা হচ্ছে না। কিন্তু যখন প্রবাসীর পাঠানো টাকা দিয়ে প্রবাসীর নামে জমি ক্রয় না করে বিশ্বাস ভঙ্গ করে কেউ তার নিজ নামে জমি ক্রয় করে ফেলে সেক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, প্রবাসীর কোন প্রকারের প্রতিকার থাকে না। উক্ত অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করলেও সেই মামলা আদতে প্রবাসীকে সন্তোষজনক কোন প্রতিকার প্রদান করে না।

 

যদিও একটা সময় আমাদের দেশে বেনামী সম্পত্তি ক্রয়ের প্রচলন ছিল যার ফলে একজন প্রবাসী যদি বিদেশ থেকে তার বাবা, ভাই-বোন বা স্ত্রীকে টাকা পাঠাত এবং উক্ত বাবা, ভাই-বোন বা স্ত্রী যদি তাদের নিজের নামে সম্পত্তি ক্রয় করত সে ক্ষেত্রে প্রবাসী দেশে ফিরে এসে উক্ত বেনামী সম্পত্তি নিজের টাকায় ক্রয় করা হয়েছে দাবি করে উক্ত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার দাবি করতে পারত। কিন্তু, Land Reform Ordinance 1984 বা ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪ জারি হওয়ার পর থেকে এখন আর কেউ বেনামী সম্পত্তি ক্রয় করতে পারে না। যার ফলে আপনার টাকা দিয়ে অন্য কেউ যদি জমি ক্রয় করলে বা আপনি অন্য কাউকে দিয়ে জমি ক্রয় করালে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে আপনি ওই জমি আপনার বলে দাবি করতে পারবেন না। এখন থেকে দলিলে যে গ্রহীতা, সেই হচ্ছে প্রকৃত মালিক। এই বিষয়টির ইতিবাচক-নেতিবাচক অনেক ধরনের মতামত রয়েছে; কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি সালিশে উপস্থিত থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝতে পারলাম যে, বেনামে সম্পত্তি ক্রয় করার বিষয়টির নেতিবাচক দিকই সবচেয়ে বেশি, আর উল্টো দিকে অধ্যাদেশটির ইতিবাচক দিকই বেশি। অর্থাৎ, বেনামী সম্পত্তি ক্রয় করার কনসেপ্টটাই নেতিবাচক; অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই ধরনের ক্রয় বাতিল করাটাই বরং ইতিবাচক।



  • প্রথমত, সাফ কবলা দলিলগুলোতে বেনামে জমি ক্রয় করা হচ্ছে এইধরনের কোনো কিছুই উল্লেখ করা থাকে না যার ফলে কে অর্থায়ন করছে সেই বিষয়ে কোন ধরনের প্রমাণ থাকছে না।
  • দ্বিতীয়ত, বেনামী সম্পত্তি ক্রয়ের ফলে অনেকেই তার কালো টাকা তার বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে জমি ক্রয় করে সাদা করার খুব সহজ উপায় অবলম্বন করতে পারেন।
  • তৃতীয়ত, আমরা জানি যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের একজন নাগরিক বা একটি পরিবার যৌথভাবে সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা জমির মালিক হতে পারে কিন্তু এইভাবে বেনামে সম্পত্তি ক্রয় করার প্রচলন যদি থাকতো তাহলে মানুষ এই আইনটিকে অমান্য করে বিভিন্ন বেনামে আরো অনেক বেশি সম্পত্তি ক্রয় করে রাখত। 
  • চতুর্থত, আমি যে সালিশে উপস্থিত ছিলাম সেই সালিশের রেফারেন্স টেনে যদি বলি, বাবা নিজের টাকায় তার তিন সন্তানের নামে জমি ক্রয় করেছিলেন তখন তার ওই তিন সন্তানই ছিল। কিন্তু বুড়ো বয়সেও তাদের আরেকটি সন্তান হওয়ার পর ওই সন্তানকে নতুন করে জমি ক্রয় করে দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা বাবার ছিলনা। বড় ৩ ভাই তাদের চতুর্থ ভাইকে সম্পত্তিতে ভাগ দিতে অস্বীকার করায়, বাবা বেনামে সম্পত্তি ক্রয় করেছিল তিন ছেলের নামে – এই অভিযোগটি তুললে যেহেতু আদালতে কোন মামলা গ্রহণ করবে না সে ক্ষেত্রে সালিশেও একই ধরনের রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এইক্ষেত্রে বাবার জন্য এই আইনটি নেতিবাচক হলেও মোটা দাগে আইনটি সকলের জন্য ইতিবাচক। যেহেতু অর্থায়নের বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য দলিলে কোন ধরনের ক্লু (clue)  থাকে না তাই একজন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বাবাকে আপনি সুবিধা দিতে গেলে তখন ঘরে ঘরে এই ধরনের বিষয় নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হবে। প্রত্যেক ক্রয়-বিক্রয়কে বেনামী বলে প্রশ্নবিদ্ধ করে মামলা করা সম্ভব।

 

তাই সম্পত্তি ক্রয় করবেন তো, নিজের নামেই ক্রয় করুন; আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে আরেকজনের নামে ক্রয় করে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বিরত থাকুন। আর একজন ব্যক্তি যে সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন এই বিষয়ে বিস্তারিত আমরা আরেকটি পর্বে লিখবো। ততক্ষণ পর্যন্ত ভাল থাকুন, চোখ রাখুন Legal Fist এর ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলে। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.