গর্ভপাত যখন অপরাধ এবং যখন নয়

গর্ভপাত

বইয়ের ভাষায়, গর্ভপাত হল ২০ সপ্তাহের আগে গর্ভাবস্থার স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষতি। যত জন মা বোন গর্ভধারণ করেন তার প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশই গর্ভপাতের মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি, কারণ অনেক গর্ভপাত হয় গর্ভাবস্থার খুব তাড়াতাড়ি – মা বোনরা গর্ভাবস্থা সম্পর্কে জানারও আগে। প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে যেমন গর্ভপাত হতে পারে, মানুষ নিজের ইচ্ছাতেও এই গর্ভপাত করিয়ে থাকে।
মানুষ যেসব কারণে গর্ভপাত করিয়ে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম হচ্ছে, স্ত্রীলোকের জীবন রক্ষা। গর্ভবতী স্ত্রীলোকটির জীবন বিপন্ন হওয়ার ভয় থাকলে তখন স্ত্রীলোকটিকে বাঁচানোর জন্যই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভপাত করানো হয়ে থাকে। প্রায় সময় হাসপাতালে ডাক্তার সাহেবরা ইঙ্গিতে বলে থাকেন যে, ‘গাছ বাঁচাতে চাইলে ফল বাঁচবে না, ফল বাঁচাতে চাইলে গাছ বাঁচবে না’। যার অর্থ হচ্ছে, ‘মাকে বাঁচানো গেলে বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না, বাচ্চাকে বাঁচালে মাকে বাঁচানো যাবে না’। তবে এসব কথাবার্তা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় বলা হলেও একই ভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার অনেক পূর্বে অর্থাৎ গর্ভে সন্তান ধারণের পর কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে যদি স্ত্রীলোককে বাঁচানোর জন্য সন্তান বা সন্তানের ভ্রূণ বা এর অস্তিত্ব হিসেবে যাই থাকবে সেটিই মেরে ফেলা বা নষ্ট করাকেই আক্ষরিক ভাবে গর্ভপাত বলা হয়ে থাকে।

তাছাড়া, ধর্ষণের ফলে কেউ সন্তান ধারণ করে থাকলে সেই সন্তানকেও অনেকেই জন্ম দিতে চায় না বলে সেটি গর্ভপাতের মাধ্যমে নষ্ট করে থাকে। আবার, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ফলে গর্ভে সন্তান চলে আসলে তখন সেই সন্তানকেও গর্ভপাতের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়। এর বাহিরেও অনেকেই সন্তান জন্ম দেওয়া ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কনসিভ করে ফেললে তখন সেই সন্তানকেও গলা টেপার পরিবর্তে গর্ভপাত করেই হত্যা করা হয়ে থাকে।
দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৮ ধারা পর্যন্ত গর্ভপাত, অপ্রসুত শিশুর ক্ষতিসাধন থেকে শুরু করে শিশুদের অনাবৃত রাখা এবং জন্ম সংক্রান্ত তথ্য গোপন করাকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা একে একে বিশদ আলোচনা করবো, তবে নিম্নে এক নজরে অপরাধের ধরন এবং এর শাস্তি নিয়ে সংক্ষেপে ছক আকারে দেখানো হল:

অপরাধের ধরন  শাস্তি
কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায় এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে এবং স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব না করে, দণ্ডবিধির ৩১২ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি তিন বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

উল্লেখ্য, যে স্ত্রীলোক নিজেই নিজের অকাল গর্ভপাত করায়, সে স্ত্রীলোকও এই ধারার অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।

কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায়, এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে এবং স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, দণ্ডবিধির ৩১২ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

উল্লেখ্য, যে স্ত্রীলোক নিজেই নিজের অকাল গর্ভপাত করায়, সে স্ত্রীলোকও এই ধারার অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।

গর্ভবতী স্ত্রীলোকের সম্মতি ছাড়া কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায় এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে এবং স্ত্রীলোকটি আসন্ন প্রসবা হোক বা না হোক, দণ্ডবিধির ৩১৩ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
কোন ব্যক্তি যদি কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজের ফলে সে স্ত্রীলোকটির মৃত্যু ঘটায়, দণ্ডবিধির ৩১৪ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
স্ত্রীলোকটির সম্মতি ছাড়া কোন ব্যক্তি যদি কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজের ফলে সে স্ত্রীলোকটির মৃত্যু ঘটায়, দণ্ডবিধির ৩১৪ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি হয় যাবজীবন কারাদণ্ডে কিংবা দশ বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুর জন্মের পূর্বে এমন কোন কাজ করে, যাতে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট হতে না পারে বা জন্মের পরে তার মৃত্যু হয় এবং অনুরূপ কাজের ফলে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট না হয় বা ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার মৃত্যু হয় এবং যদি কাজটি মাতার জীবন রক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে কৃত না হয়, দণ্ডবিধির ৩১৫ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।
যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন কার্য করে, যার দ্ধারা সে কোন মৃত্যু ঘটালে তা হলে সে অপরাধজনক নরহত্যা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হত এবং অনুরূপ কার্যের সাহায্যে একটি জীবন্ত অজাত শিশুর মৃত্যু ঘটায়, দণ্ডবিধির ৩১৬ ধারা অনুযায়ী, উক্ত ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দশ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
কোন ব্যক্তি যদি বার বৎসরের নিম্নবয়স্ক কোন শিশুর পিতা বা মাতা অথবা উক্ত শিশুর দায়িত্ব সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও শিশুটিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার উদ্দেশ্যে কোন স্থানে পরিত্যাগ করে যায় বা ফেলে যায়, দণ্ডবিধির ৩১৭ ধারা অনুযায়ী, সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।
কোন ব্যক্তি যদি শিশুকে গোপনে সমাধিস্থ করে বা অপর কোন রূপে ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুটির জন্ম গোপন করে বা গোপন করার চেষ্টা করেঃ শিশুটির মৃত্যু জন্মের আগেই হোক আর জন্মের পরেই হোক, দণ্ডবিধির ৩১৮ ধারা অনুযায়ী, উক্ত ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ বলে যে উক্তি আমরা জানি সেটি সব জায়গায় ব্যবহার করলে পৃথিবীতে মানবতা ধীরে ধীরে বিলীন হতো না। একজনকে দুনিয়াতে বয়ে আনতে আরেকজনকে চলে যেতে যাতে না হয়, সেদিকে আমরা যেমন সবাই একমত এবং সোচ্চার; তেমনি ভাবে অপরিকল্পিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কেউ পৃথিবীতে আসতে চাইলে তাকে আমরা পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র করে সামান্য প্রতিবাদ বা লড়াই করার সুযোগ না দিয়েই মেরে ফেলার বিষয়ে কেমন জানি উদাসীন। লড়াইটা সমানে সমানে হওয়া উচিত, গর্ভের সন্তানের সাথে আমাদের নোংরা লড়াই মানায় না।

আজ এই পর্যন্তই, পরবর্তী পর্ব গুলোতে আমরা প্রতিটি ধারা ধরে ধরে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়