অনার কিলিং বাড়ার কারণ এবং প্রতিকার

অনার কিলিং

ছদ্মনাম ব্যবহার করে একটি সত্য ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। ৩ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে জসীম সাহেবের সংসার। ৪ সন্তানেরই বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু সমস্যা শুধু মেয়ে সুমির সংসারে। জসীম সাহেব অনেক খতিয়ে দেখেও মেয়ের জামাই মাসুদের কোন দোষ খুঁজে পেলেন না।

তিনি যতবার খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন প্রত্যেকবারে দেখলেন যে উনার মেয়ে পরকীয়া আসক্ত। মাসুদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়ার পর তাদের একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েও রয়েছে। তারপরও বিভিন্ন ছেলেদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ থেকে আরম্ভ করে মাসুদের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন বয়সী ছেলেদের বাড়িতে আসার মত অভিযোগ ও শোনা যায়। কিন্তু মাসুদ ছেলে ভালো হওয়ার কারণে এবং শ্বশুর বাড়ির সাপোর্ট থাকার কারণে সে যথেষ্ট অভিযোগ এবং তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সুমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। কিন্তু সেটা কতদিন?

প্রায় সময় মাসুম সুমিকে মোবাইলে কল করলে ব্যস্ত পায়, পরবর্তীতে বাসায় এসে যখন দেখা যায় যে তার মোবাইলে বিভিন্ন নাম্বার থেকে কল করা হয়েছিল বা এসেছিল। তখন সেটি মাসুদ সহ্য করতে পারে না।
মাসুদ বিভিন্ন সময় বাসায় গোপন জায়গায় মোবাইল রেকর্ডার চালু করে দিয়ে অফিস চলে যেত এবং দিন শেষে বাসায় এসে মোবাইলে দেখতো যে তারই বাসায় বিভিন্ন সময় একটি ছেলে আসে এবং তারই বিছানাতে তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে। তখন আর কোনো ভাবে সহ্য করতে পারে না পেয়ে এক পর্যায়ে সুমির বাবা-মাকে জানিয়ে দেয় সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা।

সুমির বাবা মা মাসুদের কোন দোষ না পাওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে কোন আইনে ঝামেলায় যায়নি, বরং নাতনির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মাসুদকে মাথা ঠাণ্ডা করার পরামর্শ দেয়। তখন তারা সুমিকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে কিছুদিনের জন্য।
বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় ওদের সাথে সম্পর্ক ভালো করার জন্য এবং একমাত্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে হলেও যাতে নিজের চরিত্রটা ঠিক করে সে ধরনের পরামর্শ দেয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা?

সুমি বাবার বাড়িতে এসেও নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে রাতের পর রাত মোবাইলে কথা বলে। যখন তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। চক্ষু লজ্জার কারণে সুমির বাবা ভাই কেউই কিছু বলতেও পারে না, আবার ভিতরে ভিতরে সহ্য করাও তাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

কিছুদিন পর হুট করে দেখা গেল যে সুমি বাড়ি থেকে চলে গেছে। কাউকে কিছু না বলে ব্যাগ গুছিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মত করে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে। মাসুদকেও সুমির পরিবার কিছু জানায়নি, বাচ্চা শিশুটি নানা নানীর কাছে থাকতে সমস্যা না হলেও সুমি কোথায় গেছে না গেছে, খোঁজ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, থানা পুলিশও করা যাচ্ছে না।

সপ্তাহ খানিক বাদে সে আবার ফিরে আসে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানা গেছে যে, মোবাইলে এক ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়েছে, ওই ছেলেটা ওকে বিয়ে করবে বলে ঢাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু কয়েকদিন থাকার পর সে বুঝতে পারল ওই ছেলেটা মাদকাসক্ত এবং সে তাকে বিয়ে না করে বরং তার কয়েকজন বন্ধু দিয়ে শারীরিক মিলন করতে বাধ্য করেছে। আরো কত বিচ্ছিন্ন গাল গপ্প করলো যেগুলো সত্য না মিথ্যা, সেটা বুঝাই মুশকিল। কিন্তু, শুনলেই কান গরম হয়ে যায়, অথচ সুমির মুখে বা চোখে বাঁধে না এসব বলতে।
এতকিছুর পরও সুমি মাসুদের পরিবারে ফিরে যেতে চায় না। মেয়েটার ভবিষ্যতের কথাও সে একটি বার ভাবতে নারাজ। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে সে আবার মোবাইলে নিয়ে বসে। নতুন কারো না কারো সাথে কথা বলতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মনে হয় যেন আজকাল লাখো কোটি দেশী প্রবাসী অবিবাহিত যুবক বসে আছে শুধুমাত্র এসব করার জন্যই।
সুমির বাবা-মা যেখানে চেষ্টা করছে সুমিকে তার স্বামীর সংসারে পাঠাতে, সেখানে সুমি বাবা-মার কথা গুরুত্ব না দিয়ে, সন্তানের কথা চিন্তা না করে সারাক্ষণই আছে মোবাইল নিয়ে। এসব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময়ও সুমি তাকিয়ে থাকে মোবাইলের দিকে, হুটহাট চালিয়ে দিচ্ছে কোন গানের ক্লিপ, আবার কল আসছে তার।

বাবা মা কোন জরুরী কথা বলার মধ্যে তা এধরনের আচরণে বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে সুমির বাবা রাগ করে সুমির হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। এতে সুমি বাবার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালাজ করতে থাকে এবং সেখানে উপস্থিত ছিল তার দুই ভাই। তারা সুমিকে চুপ করতে বললেও সুমি সিন ক্রিয়েট করার মত আরও জোরে চেঁচাতে থাকে। এতে দুই ভাই উত্তেজিত হয়ে সুমিকে এলোপাথাড়ি প্রহার শুরু করে। একপর্যায়ে সুমির ভাইদের নামে অপবাদ দেওয়া শুরু করে, যা লিখার মত নয়।
তখন এক ভাই রাগের মাথায় সুমির গলা চেপে ধরে এবং এতটাই উত্তেজিত ছিল যে, কখন সুমির প্রাণ বেরিয়ে গেছে সেটি টেরই পায়নি। যখন ভাইয়ের হুশ ফিরল তখন ইতিমধ্যে সুমি চিরস্থির হয়ে গেছে।

উপস্থিত পরিবারের সবাই মিলে বুদ্ধি খাটিয়ে সুমিকে পানিতে ফেলে দেয়। সুমির আগে থেকেই মৃগী রোগ ছিল। গোসল করতে গিয়ে মৃগী রোগের প্রভাবে পানিতে ডুবে মারা গেছে বলে প্রচার করার চেষ্টা করে। যদিও পরক্ষণে সেটি জানাজানি হয়ে যাওয়ার কারণে পুরো পরিবারকেই ওই খুনের জন্য দোষারোপ করা হয়। যদিও এই খুনটি পূর্ব পরিকল্পিত নয়, উত্তেজনার বশত। কিন্তু এই ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে আমাদের সমাজে, যেখানে পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে অনার কিলিং করা হয়ে থাকে।
একটি ছেলে বা মেয়ের চারিত্রিক সমস্যার কারণে যে শুধুমাত্র তারই সম্মানহানি হয়, তা কিন্তু নয়; একই সাথে তার পরিবারেরও সম্মানহানি হয়ে থাকে। একটি ছেলে কিংবা মেয়ের যখন তালাক হয়, তখন শুধুমাত্র তাকেই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না, তার পরিবারকেও যেতে হয়। একটি ছেলে কিংবা মেয়ে যখন মাদকাসক্ত হয় তখন শুধুমাত্র তাকে নিয়েই মানুষ কটূক্তি করে না, তার পরিবারকে নিয়েও কটূক্তি করে থাকে।

 

তবে এর মানে কিন্তু এই নয় যে, ঐ চরিত্রহীন বা মাদকাসক্ত সন্তানের পরিবার আইন নিজের হাতে তুলে নিবে। চরিত্রহীন কিংবা মাদকাসক্ত সন্তানকে শাসন কিংবা নিয়ন্ত্রণে আনার পরিবর্তে তাকে খুন করার অধিকার কোনো বাবা মায়ের নেই
উল্লেখ্য, আজকাল মিডিয়াতে না আসলেও ভেতর থেকে অনেক খবর শোনা যায় যে, অনেক পরিবারেই গে বা লেসবিয়ানদের সংখ্যা বাড়ছে, যা বাবা মায়ের জন্য মেনে নেওয়া অসম্ভব। সমাজ, ধর্ম মেনে নিবে না বলে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে আর যারা ঐসব করতে পারছে না, তারা অন্যায়ের পথ বেছে নিচ্ছে।

অনার কিলিং নতুন কোন অপরাধ না, এটিও অন্য পাঁচটি খুনের মতই খুন। কিন্তু, পরিবারের মূল্যবোধ বা ধর্মীয় বিশ্বাসের বাহিরে গেলে যেমন পরিবার মেনে নিতে পারে না তেমনি পরিবারের আপনজনদের দ্বারা খুন সমাজে ভীষণ আতঙ্কের পাশাপাশি অনিশ্চয়তা তৈরি করে। টলারেন্স ক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদেরকে সংস্কৃতি, ধর্ম এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত, এতেই সমাজে অপরাধ কমিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়