ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনঃ পর্ব ২

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আমরা যেহেতু প্রতিনিয়তই ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি এবং প্রতিদিনই ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে খেলাধুলা, বিনোদন, সাহিত্য ইত্যাদিসহ জাতীয় রাজনীতির বিষয়াদি নিয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে থাকে, সেহেতু আমাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্বন্ধে ভালো ধারণা থাকা উচিত। অন্যথায় আমাদের কোন মতামতটি এ আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে, সেটা না জেনে যদি আমরা কোন মতামত প্রকাশ করি, কে জানে হয়ত সেটি আমাদেরকে জেল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে। তাই আসুন, কোথাও কোনো একটি স্ট্যাটাস বা কমেন্ট বা কোন কিছু শেয়ার করার আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্বন্ধে খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিই। আমরা কয়েকটি পর্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে কোন কোন কাজটি অপরাধ এবং সেই অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি কি, সেটি নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করব। আপনি পরবর্তী স্ট্যাটাস বা কমেন্ট বা শেয়ার বাটনে ক্লিক করার আগে, দয়া করে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে নিন যে, আপনাকে কি স্ট্যাটাস দেওয়া উচিত, কি কমেন্ট করা উচিত এবং কি শেয়ার করা উচিত; vice-versa কি স্ট্যাটাস দেওয়া উচিত নয়, কি কমেন্ট করা উচিত নয় এবং কি ধরনের পোস্ট শেয়ার করা উচিত নয়।

  • যদি কোন ব্যক্তি ফেসবুক বা অন্য যেকোনো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রোপ্যাগান্ডা প্রচার করে বা এই প্রোপ্যাগান্ডা প্রচারে কেউ মদদ বা উস্কানি দেয়, তাহলে যে প্রোপাগান্ডা দিয়েছেন যে বা যাহারা প্রোপাগান্ডার দিয়েছে তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারার অধীনে অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে। আর কেউ যদি এই ধারায় অপরাধ করেছে বলে আদালতে প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা আদালত চাইলে অপরাধীকে উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত করতে পারেন। কিন্তু অপরাধী যদি একই অপরাধ দ্বিতীয় বার বা বার বার করে থাকে, সে ক্ষেত্রে আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

 

  • অনেকেই অনেক ধরনের জালিয়াতি করে থাকে আর জালিয়াতি করতে হলে কোন না কোন ডকুমেন্টকে নকল বা জাল তথা জালিয়াতি করতে হয়। এখন কোন ডকুমেন্ট বা অন্য কোন কিছু জালিয়াতি করতে কেউ যদি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে সেক্ষেত্রে সেটিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২২ ধারার অধীনে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।‘ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি’ বলতে আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যে কিনা বিনা অধিকারে বা যে অধিকার প্রদান করা হয়েছে তার অতিরিক্ত হিসাবে বা অনধিকার চর্চার মাধ্যমে কোনো কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসের ইনপুট বা আউটপুট প্রস্তুত, পরিবর্তন, মুছে ফেলা ও লুকানোর মাধ্যমে অশুদ্ধ ডাটা বা প্রোগ্রাম, তথ্য বা ভ্রান্ত কার্য, তথ্য সিস্টেম, কম্পিউটার বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করাকে বুঝানো হবে। যেমন ধরুন, কোন ব্যক্তি এসএসসি পাস না করেও কম্পিউটারের গ্রাফিক্স বা অন্য যে কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে তার নিজের নামে বা অন্য কারো নামে এসএসসি’র সার্টিফিকেট তৈরি করে ফেলে, সেই ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করার জালিয়াতি করার ফলে ২২ ধারার অধীনে অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, ২২ ধারার অধীনে কোন ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে, অর্থাৎ ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি করে থাকলে, সেই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। আরো উল্লেখ্য এই যে, যদি কোন ব্যক্তি ২২ ধারার অধীন দ্বিতীয় বার বা বার বার এই অপরাধ করে থাকে, সেই ক্ষেত্রে তাকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

 

  • জালিয়াতির মতো প্রতারণা নিয়েও রয়েছে প্রতিকার৷ ‘ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রতারণা‘ বলতে কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে বা জ্ঞাতসারে অথবা অনুমতি ছাড়া কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম, ডিজিটাল নেটওয়ার্কে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোন তথ্য পরিবর্তন করা, মুছে ফেলা, নতুন কোন তথ্যের সংযুক্তি বা বিকৃতি ঘটানোর মাধ্যমে এর মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস করা, তার নিজের বা অন্য কোনো ব্যক্তির কোনো সুবিধা প্রাপ্তির বা ক্ষতি করার চেষ্টা করা বা ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করার মাধ্যমে প্রতারণা করেন, তাহলে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩ ধারার অধীনে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। অনেক সময় আমরা দেখে থাকি, ফেসবুক বা ইউটিউব এর মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে কোন সত্য তথ্য-উপাত্ত কে সংশোধন করে এর মূল্যমান বা মর্যাদা হ্রাস করে বা হেয় করে প্রচার করা হয়, যা কোন নির্দিষ্ট মহলকে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে আর পুরো কাজটি করা হয় ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক্স এর মাধ্যমে এবং এটি যেহেতু আপাতদৃষ্টিতে একটি প্রতারণা সেহেতু ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যম ব্যবহার করার কারণে এটি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক্স প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হবে। আর কোন ব্যক্তি যদি এই ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা করে থাকে এবং সেটি আদালতে প্রমাণিত হয়, সেই ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় বার বা বারংবার এই অপরাধ সংগঠন করে থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

অফলাইনে আমরা প্রতিদিন হাজারটা কথা বলি, কোনটাই হয়ত সংরক্ষণে থাকছে না। কিন্তু, অনলাইনে কাউকে ১ শব্দের গালি দিলেও তা সংরক্ষণ থেকে যাচ্ছে আর এটার জন্য ও ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাই, এবার হিসেব কষে স্ট্যাটাস দিন, কমেন্ট করুন এবং শেয়ার করুন। উল্লেখ্য, হিসেব কষতে হলে আপনাকে আইন জানতে হবে আর আইন জানতে হলে আপনাকে আমাদের সাথে অর্থাৎ লিগ্যালফিস্টের সাথে থাকতে হবে৷

 

[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১পর্ব ৩  ]

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়