নিজের পছন্দে বিয়ে ও একটি অনার কিলিং

অনার কিলিং

রফিক সাহেব ঢাকার একজন সুনামধন্য ব্যবসায়ী। ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত কাজে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া আসা করা লাগে বলে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি মেইনটেইন করেন। রফিক সাহেব নিজে গাড়ি চালাতে পারেন না, তাই একজন ব্যক্তিগত ড্রাইভার রেখেছেন। রফিক সাহেবের কাজকর্মের বাহিরেও ড্রাইভার রফিক সাহেবের স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে বাহিরে যাওয়া আসার সময় ড্রাইভ করে নিয়ে যান।
এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে রফিক সাহেবের কলেজ পড়ুয়া এক মেয়ে রয়েছে। ওই দিকে ড্রাইভারও বয়সে তরুণ। কলেজে আনা নেওয়ার সময় টুকটাক কথাবার্তার আদান-প্রদানের মাধ্যমে এক সময় রফিক সাহেবের মেয়ের সাথে রফিক সাহেবের গাড়ির ড্রাইভারের প্রণয় শুরু হয়।

রফিক সাহেবের কন্যা বুঝতে পারে যে তাদের এই সম্পর্ক কখনোই তার পরিবার মেনে নিবে না, তাই একদিন সুযোগ বুঝে বাসা থেকে কিছু টাকা পয়সা এবং স্বর্ণালংকার নিয়ে উক্ত ড্রাইভারের সাথে রফিক সাহেবের কন্যা পালিয়ে যায়। মেয়ে বাবা মাকে ফোন করে বলে যে সে নিজের ইচ্ছায় পছন্দ করে বিয়ে করেছে এবং সে কোন প্রকার প্ররোচনা বা প্রলোভন ছাড়াই এই বিয়ে করেছে। তারা ভালো আছে এবং বাবা মা যাতে তাদের খোঁজার চেষ্টা না করে। তাদেরকে মেনে নিলেই বরং তারা বাড়ি ফিরে আসবে, অন্যথায় নয়।

এদিকে রফিক সাহেবের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে যে সোসাইটিতে তিনি বসবাস করতেন সেখানকার সবার কাছে রফিক সাহেবের সম্মানহানি হল। মেয়ের এমন কর্মকাণ্ডে রফিক সাহেব প্রথমে লজ্জা এবং হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন, তারপর সময় গড়াতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। থানা পুলিশ করে মেয়েকে যখন খুঁজে পেলেন তখন অপহরণের মামলা পাশাপাশি বিভিন্ন মামলা দিয়ে ড্রাইভারকে পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন আর মেয়েকে বাসায় নিজের কাস্টাডিতে নিয়ে আসেন।

ঘটনাটা এখানেও শেষ হতে পারতো কিন্তু রাগে, ক্ষোভে এবং চারপাশের বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কথায় রফিক সাহেব এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েকে বিভিন্ন ভাবে প্রহার করতে থাকে। একদিকে যখন রফিক সাহেবের মেয়ের চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কটূক্তি শুরু করেছে, অন্যদিকে রফিক সাহেবকে অহংকারী, অর্থ লোভী বিভিন্ন কথা বলে এক ধরনের নরপিশাচের ন্যায় সমাজে উপস্থাপন করতে থাকে। তাছাড়া আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বদৌলতে কোন ঘটনা আর চাপা থাকে না, বরং রংচং মেখে ঘটনা যা না তার চেয়েও বেশি রূপ ধারণ করে।

যার ফলশ্রুতিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের কোথাও রফিক সাহেব আর আগের মত বিচরণ করতে পারছেন না মেয়ের এমন কর্মকাণ্ডের জেরে। বহুমুখী চাপে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রফিক সাহেব পালা করে মেয়ের উপর রাগ ঝাড়তে লাগলেন এবং সেই রাগ এক সময় রফিক সাহেবকে সত্যিকার অর্থেই নরপিশাচে পরিণত করে।

রফিক সাহেবের মেয়েকে ডিফেন্স করার মত বা তাকে আগলে রাখার মত তার পরিবারে কেউ ছিল না। পরিবারের অন্যান্য পুরুষ কিংবা মহিলা সদস্যরাও রফিক সাহেবের মেয়ের উপর চড়াও এবং আক্রমণাত্মক ছিল ঘটনার শুরু থেকেই।
অল্প বয়সে প্রেম ভালোবাসায় যথেষ্ট পরিমাণ আবেগ, স্বপ্ন, মায়া থাকে বলে ঐ ভালোবাসা ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণা মানুষকে আত্নহত্যার কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। রফিক সাহেবের মেয়ে একে তো ঐ ধরণেরই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার উপর রাগে অভিমানে খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে সকাল বিকাল বিভিন্ন কটূক্তি (যেমন, তোর মত মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো) শুনার পাশাপাশি শারীরিক প্রহারের ফলে একসময় মেয়েটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাবা মা শুধু আত্মসম্মানবোধের দিকেই নজর দিয়েছিল, মেয়ের শরীরের দিকে কোন নজর তাদের ছিল না।

মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার আগেই তাকে কবরস্থ করা হয়, যাতে নতুন করে আর সম্মানহানি না হয়। তখন কেউ কেউ সেটিকে স্ট্রোক বলে চালিয়ে দিয়েছিল, কেউবা সুইসাইড কিন্তু সত্যিকারের যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি অনার কিলিং।

অনার কিলিং এর জন্য ধর্মীয় কারণকে যতটাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হোক না কেন আদৌতে অনার কিলিং এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে পারিবারিক সম্মান বা মূল্যবোধ বা পছন্দ অপছন্দ। পারিবারিক পছন্দের বাহিরে যখনই কোন মেয়ে বা মহিলা যায়, তখনই তার বিরুদ্ধে অনার কিলিং এর আশঙ্কা তৈরি হয়। কোন মেয়েকে যখন পরিবার থেকে পছন্দ করে বিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় আর মেয়ে যখন সেটাতে আপত্তি করে তখনই মেয়ের উপর নানা ধরনের নির্যাতন শুরু হয়।

তাছাড়া মেয়ে যখন কোন ছেলেকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায় সেক্ষেত্রে সেটি যদি স্ট্যাটাস-গত মিল না থাকে কিংবা যদি ধর্মীয় কোন ভেদাভেদ থাকে যেমন ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায় বা ধর্মের মধ্যেও যদি গোত্রগত সমস্যা থেকে থাকে, সেই ক্ষেত্রে ওই মেয়ের উপর পারিবারিক চাপ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
আবার, স্ত্রী যদি কোন ভাবে পরকীয়া আসক্ত হয় কিংবা যদি স্ত্রী পরকীয়া করছে বলে স্বামীর মনে কোন ধরনের সন্দেহের ডানা বাঁধে, সে ক্ষেত্রে সেই স্ত্রীর প্রতি অনার কিলিং এর আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। যদিও বিভিন্ন দেশেই স্ত্রীকে হাতে নাতে পরকীয়া করা অবস্থায় দেখে খুন করার নজির রয়েছে, কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও সেটি অপরাধ। কেননা কেউ যদি কোন অপরাধ করে থাকে সে ক্ষেত্রে সেটির জন্য আইন রয়েছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোন সুযোগ আমাদের নেই।

মিডিল ইস্ট বা মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার মত দেশগুলোতে অনার কিলিং এর পরিমাণ বেশি হওয়ার মূল কারণটি হচ্ছে পারিবারিক মূল্যবোধ। পশ্চিমের দেশগুলোতে পারিবারিক মূল্যবোধ নেই বললেই চলে। কেননা সন্তানরা একটু বড় হলেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলে তারা প্রত্যেকে বাবা মা থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে, তারা কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে, কার সাথে থাকবে এই নিয়ে বাবা মা তাদেরকে কোন বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে না।

কিন্তু আমাদের দেশে নেহাতি বাধ্য না হলে কেউই তার সন্তানকে তাদের থেকে আলাদা করে না। আর সন্তানরাও যথাসম্ভব বাবা মায়ের সাথে থাকাটা উপভোগ করে বা অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাছাড়া সম্পত্তির যে উত্তরাধিকার বা সম্পত্তির দেখভাল করার জন্য বাবা-মা নিজেরাই তাদের সন্তানদেরকে নিজেদের কাছে রেখেই বড় করতে চায়। এ কারণে সন্তান কি করবে, কার সাথে থাকবে, কার সাথে চলাফেরা করবে, বন্ধু-বান্ধব হিসেবে কাদেরকে নির্বাচন করবে, এমনকি কোন বিষয়ে পড়াশোনা বা কোথায় চাকরী করবে সেটি পর্যন্ত বাবা-মায়ের পছন্দ-অপছন্দ সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেয়।

প্রত্যেকেরই নিজের জীবন উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। সন্তানদেরকে অবশ্যই পারিবারিক মূল্যবোধ বজায় রেখে চলতে হবে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। কিন্তু তাদের নিজস্ব ব্যক্তি স্বাধীনতা চর্চার অধিকারও দেওয়া উচিত। আপনার পরিবারের মূল্যবোধের বিপরীতে কিছু করে থাকলে তাকে শাস্তি হিসেবে পরিবার থেকে বের করে দিতে পারেন, ধর্মের বিরুদ্ধে গেলে রাষ্ট্রে আইন আছে, আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু, কোনভাবেই একটি প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনার নেই।

আসুন সবাই সবার জায়গা থেকে একে অন্যের সহায়ক হয়ে উঠি, আইন মান্য করি আর অন্যকে আইন মান্য করতে উৎসাহিত করি, ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়