যৌতুক দাবি ও নির্যাতন আইন

যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টা

ফৌজদারি আইন

ছোট বেলার একটি ঘটনা আমার আজও স্পষ্ট খেয়াল আছে যে, একবার আমাদের পাশের গ্রামের এক লোক তার স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে অতিরিক্ত ক্ষুব্ধ হয়ে, এক পায়ের জুতা খুলে স্ত্রীর দিকে নিক্ষেপ করে। এতে স্ত্রীর এক চোখের উপর এমন ভাবে জুতাটি পড়ে যে, তাৎক্ষণিক স্ত্রী চোখের যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখা গেল তেমন বড় কোন অসুবিধা না হলেও ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে একটা লম্বা সময় চোখের চিকিৎসা করাতে হয়েছে। ততদিনে স্ত্রী লোকটির বাবার বাড়ির লোকজন ইতিমধ্যে মামলা মোকদ্দমা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখন ঐ স্বামী লোকটি হাসপাতালে গিয়ে স্ত্রীর কানে নিয়ে বলল, মামলা করবে নাকি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে যাবে?
এখনো কিছু আর্থিক সমস্যা থাকলেও সংসারটি আজও দিব্যি টিকে আছে। ঘটনাটি আমার এক প্রতিবেশীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়র। আমি ঘটনাটি তুলে ধরলাম এজন্যই যে, নির্যাতন হয়ত আইন দিয়ে বন্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু আইন দিয়ে আসলে সংসার টিকিয়ে রাখা যায় না। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে, এডজাস্টমেন্ট করে চলা জরুরী। আমাদের ধর্মেও বলা হয়েছে যে, স্বামী রেগে গেলে স্ত্রী চুপ থাকবে আর স্ত্রী রেগে গেলে স্বামী চুপ থাকবে। দুইজনই রেগে গেলে সংসারে আর সুখ বিদ্যমান নাও থাকতে পারে। আর, এখন তো কথায় বা তালাক, আর যৌতুক দাবিতে নির্যাতনের মামলা। এসব মামলা আদৌ কাউকে সুখী করেছে বলে আমার জানা নেই। তারপরও আইন যেহেতু আছে, সেহেতু সেটা আমার দায়িত্ব। আসুন জানি, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টা সম্বন্ধে আইনে কি আছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১১ ধারা বর্ণিত, যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তির যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন কিংবা উক্ত নারীকে মারাত্মক জখম করেন তাহা হইলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি-
(ক) মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
(খ) মারাত্মক জখম করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অনধিক বার বছর কিংবা অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
(গ) সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম দণ্ডিত হবে এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যৌতুক কাকে বলে? আমরা সচরাচর যা জানি, অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর কাছে কোন অর্থ বা সহযোগিতা দাবি করলে সেটিকে আমরা যৌতুক চিনি বা জানি। কিন্তু আইন কি বলে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০ এর ধারা ২ (ঞ) তে যৌতুকের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
২ (ঞ) মতে যৌতুক অর্থ-
(অ) কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বর পক্ষের কোন ব্যক্তির কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসেবে বিবাহের কণে পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ, অথবা
(আ) কোন বিবাহের কণে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বর পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ।
যৌতুকের এই সংজ্ঞাতেও যৌতুকের বিষয়ে স্পষ্টত ধারণা পাওয়া মুশকিল। আইনে সংজ্ঞা দেওয়ার পরও অনেক মামলার রায়ে বারবারই যৌতুকের সংজ্ঞাকে স্পষ্টত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

37 DLR 230 মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, অনেক উপাদানের সমন্বয়ে যৌতুক গঠিত হয়। প্রথমত: যৌতুক হতে গেলে একে যে কোন সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত হবে। পক্ষগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যৌতুক দিতে হবে বা দেবার সম্মতি প্রদান করতে হবে এবং উহা পক্ষগণের বিবাহের জন্য প্রতিদান হতে হবে। বিবাহের প্রতিদান হিসাবে যে সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত দিতে হবে বা দেওয়ার সম্মতি প্রদান করতে হবে তাই যৌতুক।
আবার দেখা যায় যে, 37 DLR 227, Mehir Lal Poddar vs Zunu Rani মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, আইন সভা খুব সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করেন যে, শুধু বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের সময় যৌতুক গ্রহণ করা বা সহযোগিতা করাই অপরাধ নহে। কিন্তু বিবাহের পরে যৌতুক চাওয়া হলেও এ অপরাধের আওতাভুক্ত হবে।
কিন্তু তার ঠিক ৩ বছর পরে 40 DLR (AD) 169 মামলার রায়ে বলা হয়েছে , বিবাহের আগে বা বিবাহের সময় যৌতুক গ্রহণ বা সহযোগিতা করা অপরাধ নয়। বিবাহের পর যৌতুক চাওয়া হলে তা অপরাধ।
আবার, 9 BLD (HSD) 73, Salma Khatun And Other vs State মামলার রায়ে বলা হয়েছে, যৌতুক সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত তখনই যৌতুক হবে যখন বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের সময় দাবী করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মহিলার স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক যেকোনো ধরনের আত্মীয় স্বজন যে কোন সময় বিবাহের প্রতিদান হিসেবে যৌতুক দাবী করলেও অত্র ধারায় অপরাধ করেছ।

দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ মামলার রায়েই সময়টাকে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। যার ফলে নিজেকে নিরাপদ রাখতে ধরে নিতে হবে যে, বিয়ের আগে হোক, বিয়ের সময় হোক বা বিয়ের পরে হোক, বিবাহের প্রতিদান স্বরূপ বর পক্ষের কেউ কণে পক্ষের কারো কাছে নগদ অর্থ না অন্য কোন কিছু দাবি করলেই তা যৌতুক বলে গণ্য হবে। আর, এই যৌতুকের জন্য স্ত্রী লোকটিকে সাধারণ জখম করা হয় তবে অন্তত ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড সাথে অতিরিক্ত অর্থ দণ্ড। আর যদি মারাত্মক জখম করা হয়, তবে অন্তত ৫ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন বা ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড সাথে অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। আবার, মৃত্যু ঘটালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে; তবে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে সাথে উভয় ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত দণ্ডিত হবে।

নারী কখনো ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু নয় আর সমাজের বোঝাও নয়। আপনি নিজেও নারীর গর্ভ থেকে এসেছে, তাহলে নারীকে অবজ্ঞা করার কোন যুক্তি নেই। স্ত্রীকে বিবাহ করে আনবেন, তাকে ভোগ করবেন, তাকে দিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ করাবেন, তার গর্ভেই আপনার সন্তান জন্ম নিবে, তাহলে তাকে কেন এতো অবজ্ঞা যে, তাকে বিবাহ করতে তার বাবা আপনাকে যৌতুক দিতে হবে?

আবার, স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং স্বামীকে নিয়ে বন্ধুর পথে বন্ধু হয়ে একটা লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার মাঝেই আপনার সার্থকতা। বিয়ের পর স্বামীকে ঘিরেই আপনার সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত। আপনি কি প্রত্যাশা করেছিলেন বা আপনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজের বর্তমান আর বাস্তবতা মেনে নিয়ে, সুখী হওয়ার পথ বের করা উচিত। সুখী নই, এটা না বলে কীভাবে সুখে হবেন সেটা নিয়েই ভাবুন। মামলা আপনাকে প্রতিশোধের আগুনে পোড়াবে, সংসারের সুখে উৎফুল্ল করবে না। বলা বাহুল্য, Exception is not an example.

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.