জামিন অযোগ্য অপরাধেও যখন জামিন পাওয়া যায়

ফৌজদারি তথা একটি ক্রিমিনাল মামলার ক্ষেত্রে সাধারণত একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীকে মামলার বিচারকার্য চলাকালীন সময় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। কারন, আসামী যাতে বিচারকার্য ছেড়ে পালাতে না পারে বা সে যে অপরাধের কারনে অভিযুক্ত উক্ত অপরাধের কোন সাক্ষীকে ভয় ভীতি দেখাতে না পারে বা সাক্ষীর কোন ক্ষতি করতে না পারে বা অপরাধের আলামত নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু, ঐ আসামী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির আবার অধিকার রয়েছে বিচারকার্য চলার সময়টিতে কারাগারে বন্দী না থাকার। কেননা, অপরাধ প্রমান হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন অভিযুক্তকে Innocent তথা নিষ্পাপ হিসেবে ধরে নিতে হবে। তাহলে, বিচারকার্যে অভিযোগ প্রমান হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে সাজা ভোগ করতে হবে কেন?- তাই রয়েছে পরিস্থিতি ভেদে জামিনের বিধান।

জামিন সংক্রান্ত বিধান ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ থেকে ৪৯৮ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত কোন মামলায় যখন কোন ব্যক্তিকে সন্দেহ করে আটক করা হয়, যাকে আমরা অভিযুক্ত বা আসামি হিসেবে জেনে থাকি, মামলার তদন্ত চলাকালীন এবং তদন্ত শেষে বিচার চলাকালীন সময়ে ওই ব্যক্তিকে যাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা বা আদালতের প্রয়োজনবোধে উপস্থিত করা যায় এবং বিচার শেষে উক্ত ব্যক্তি যদি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়, সেক্ষেত্রে তার শাস্তি কার্যকর করার জন্য তাকে যাতে সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় আবার ওই ব্যক্তি যাতে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে না পারে, তাই একটি মামলার শুরু থেকেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে আটক রাখা হয়। তবে কোনো মামলাতেই কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে আটক রাখা হলে, ওই ব্যক্তি আদালতের কাছে জামিনে মুক্তি চেয়ে আবেদন করতে পারেন।

ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে কিছু অপরাধ রয়েছে যেগুলো জামিনযোগ্য এবং কিছু অপরাধ রয়েছে যেগুলো জামিন অযোগ্য। যে অপরাধগুলো জামিনযোগ্য সেই অপরাধগুলোর দায়ে কোন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হলে এবং তাকে কারাগারে আটক রাখা হলে সে যদি আদালতের কাছে জামিনের আবেদন করে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আদালত থেকে জামিন দিবে। কেননা জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া তার আইনগত অধিকার এবং জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য আদেশ সূচক।

অন্য দিকে জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতের নিকট জামিনের আবেদন করতে পারেন। কিন্তু জামিন অযোগ্য অপরাধ জামিন দেওয়া আদালতের আদেশ সূচক নয় বরং সেটি আদালতের বিবেচনা মূলক ক্ষমতা। আদালত জামিন দিতেও পারে আবার জামিন নাও দিতে পারেন। তবে জামিন অযোগ্য অপরাধ গুলোর মধ্যে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি এমন কোন অপরাধ করে থাকে যার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আদালতের কাছে যদি মনে হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত অপরাধ করেছে বা যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে ওই ব্যক্তিকে প্রকৃত অপরাধী মনে করার, সেক্ষেত্রে আদালতের জন্য এটি আদেশসূচক যে, আদালত যাতে উক্ত আসামি বা অভিযুক্তকে জামিন না দেয়। কিন্তু তিন শ্রেণীর ব্যক্তিকে জামিন অযোগ্য অপরাধে আদালত জামিন দিতে পারেন। ঐ ৩ শ্রেণী হচ্ছে,

  • জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি যার বয়স ১৬ বছরের নিচে।
  • জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন স্ত্রীলোক।
  • জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি যিনি পীড়িত বা অক্ষম।

এই তিন শ্রেণীর ব্যক্তি কে আদালত জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও জামিন দিতে পারেন। কিন্তু পরিস্থিতির বিবেচনায় আরো কিছু আইনি বিধান রয়েছে বা বলা চলে সুবিধা রয়েছে যার মাধ্যমে জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি উপরিউক্ত তিন শ্রেণীর মধ্যে না পড়লেও অর্থাৎ সকল শ্রেণীর অভিযুক্ত বা আসামি জামিন পেতে পারে।

কতিপয় ক্ষেত্র গুলো হচ্ছেঃ

  • পুলিশ যদি ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য অপরাধে আসামি বা অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া যেতে পারে।
  • ১৮০ দিনের মধ্যে যদি ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য শেষ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্বেও অভিযুক্ত বা আসামিকে আদালত সন্তুষ্ট সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
  • ৩৬০ দিনের মধ্যে যদি দায়রা আদালত বিচারকার্য শেষ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্বেও অভিযুক্ত বা আসামিকে আদালত সন্তুষ্ট সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
  • যদি কোন অভিযুক্ত বা আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালত যেকোনো বর্ণনার সাজার ঘোষণা করেন, সেই ক্ষেত্রে উক্ত সাজাপ্রাপ্ত আসামী যদি উচ্চতর আদালতে আপিল করে সেক্ষেত্রে আপিল চলাকালীন সময়ে আপিল আদালত নিম্ন আদালতের দন্ড স্থগিত করে আপিলকারী আসামিকে জামিন দিতে পারেন।

তাছাড়া আগাম জামিন নামক আরেকটি জামিনের সুবিধা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বেই জামিন নিয়ে রাখতে পারেন, যাতে তিনি সম্ভাব্য গ্রেপ্তার এড়াতে পারেন। এই ক্ষেত্রে সাধারণত কোন ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, কোন অপরাধের জন্য ওনাকে সন্দেহ করা হচ্ছে এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে, সেই ক্ষেত্রে তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বা দায়রা জজের নিকট আগাম জামিনের আবেদন করতে পারেন। শুধুমাত্র এই দুই আদালতকেই আগাম জামিন প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে আগাম জামিন দেওয়ার আদালত সাধারণত তিনটি বিষয় বিবেচনা করে থাকেন।

  • যদি ঐ ব্যক্তির পক্ষে নিম্ন আদালতে হাজির হওয়া কোনো কারণে সম্ভব না হয়।
  • রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করার জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হলে।
  • আদালত বিশেষ অবস্থায় স্ববিবেচনায় সঙ্গত মনে করলে আবেদনকারীকে আগাম জামিন দিতে পারেন।

জামিনযোগ্য অপরাধে তো জামিন পাওয়াই যায়, কিন্তু জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামিনে মুক্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া, অবাঞ্ছিত ঝামেলা তথা গ্রেফতার এড়াতে আগাম জামিন নিয়ে রাখার বিধানও আমরা আজ জানতে পারলাম। ভবিষ্যতে আমরা জামিন নিয়ে আরও বিস্তারিত জানবো উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজীরের আলোকে। আজ এই পর্যন্তই, আল্লাহ হাফেজ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়