রায়ের পূর্বের এবং পরের কারাবাসের দিন গণনা

jail before sentencing

Arrest before judgment বা ‘বিচারের আগে গ্রেফতার’ এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে, একজন ব্যক্তিকে আদালতে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই আইনের হেফাজতে নেওয়া হয়, যাতে বিচারের ভয়ে সে পালিয়ে যেতে না পারে বা সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করতে না পারে। এই ধরনের গ্রেফতার সাধারণত সম্ভাব্য কারণের ভিত্তিতে করা হয়, যেখানে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ থাকে যে উক্ত ব্যক্তি অপরাধ করেছে এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দাবির সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচার না হওয়া পর্যন্ত বা বিচার চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে জামিনে মুক্তি পেতে পারেন। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আইনগত অধিকার বলে জামিন পাবেন আর জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে বয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা অসুস্থতার ভিত্তিতে জামিন পেতে পারেন। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া যেমন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক, তেমনি জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য বিবেচনামূলক; আদালত ইচ্ছে করলে দিতেও পারেন আবার নাও দিতে পারেন।

এখন কথা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট অপরাধে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল। এখন উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়, তাহলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করবেন। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া গেলে বা জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া না গেলেও, পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করা বা মামলার এক তারিখ থেকে অন্য তারিখের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কিছুদিন কারাবাস করা লাগতে পারে।
জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে হয়ত অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতারের আগেই জামিন নিয়ে নিচ্ছে। আর গ্রেফতারের পরেও যদি জামিনের আবেদন করে সেক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। তাই হয়ত সেভাবে তার কারাবাস হচ্ছে না। কিন্তু, যদি জামিনযোগ্য অপরাধেও অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনের শর্ত অমান্য করে, আদালতের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়ে গরহাজিরা দেয়, তাহলে জামিন বাতিল হয়ে যেতে পারে। আর জামিন বাতিল করা হলে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে জামিন পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিছুদিন কারাবাস করা লাগতে পারে। আবার, জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যদি জামিন মঞ্জুর না হয়, তাহলেও আসামীকে কারাবাস করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি রায়ের পূর্বেও কারাবাস করে আবার রায়েও যদি সাব্যস্ত হয়, তাহলেও তো তাকে পুনরায় কারাবাস করতে হবে, সেক্ষেত্রে তার কারাবাসের গণনা কিভাবে হবে?

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ক ধারা অনুযায়ী, যদি বিচার চলাকালীন সময়ে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা যাকে আমরা আসামী বলে থাকি, সে ব্যক্তি যদি কারাবাস করে তথা জেল হাজতে থাকে এবং বিচারকার্য শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়, তাহলে দণ্ডিত হওয়ার পূর্বে তিনি যে কয়দিন কারাবাস করেছিলেন, সেই দিনগুলো বাদ দিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে জামিন পাওয়া না পাওয়ার মাঝে লাগাতার বা বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় ৬ মাস জেল হাজতে ছিলেন। এমতাবস্থায়, বিচারকার্য শেষে দেখা গেলো যে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তাকে ৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এখন তিনি কতদিন কারাবাস করবেন?- উত্তর হচ্ছে ৩ বছর থেকে ৬ মাস বাদ দিয়ে বাকি সময়, অর্থাৎ ২ বছর ৬ মাস সময় কারাবাস করতে হবে।
এই সহজ হিসেব বুঝতে আশা করি কারো কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু, বিপত্তি হচ্ছে যদি কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে যে পরিমাণ কারাবাস বা জেল হাজতে ছিল, তার পরিমাণ যদি বিচারকার্য শেষে আদালত কর্তৃক ঘোষিত দণ্ডের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে তাহলে কি হবে?
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ক (২) ধারা অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী যদি বিচার শেষে যে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়, তার চেয়ে দণ্ডিত হওয়ার পূর্বেই অধিক মেয়াদে কারাবাস করে থাকে, তাহলে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীকে কারাবাস থেকে মুক্তি দিতে হবে এবং কারাদণ্ডের সাথে আসামীর বিরুদ্ধে যদি কোন অর্থদণ্ড থেকে থাকে তাহলে সেই অর্থদণ্ডও মওকুফ করা হবে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে জামিন পাওয়া না পাওয়ার মাঝে লাগাতার বা বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় ২ বছর ৩ মাস জেল হাজতে ছিলেন। এমতাবস্থায়, বিচারকার্য শেষে দেখা গেলো যে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং সেটি মাত্র ২ বছরের কারাদণ্ড। এখন তিনি কতদিন কারাবাস করবেন?- উত্তর হচ্ছে, উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীকে কারাবাস থেকে মুক্তি দিতে হবে এবং কারাদণ্ডের সাথে আসামীর বিরুদ্ধে যদি কোন অর্থদণ্ড থেকে থাকে তাহলে সেই অর্থদণ্ডও মওকুফ করা হবে।
এখন পাঠকের কাছে আমাদের প্রশ্ন, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী বিচার শেষে যে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়, তার সম পরিমাণ কারাবাস যদি সে ইতিমধ্যে ভোগ করে থাকে, তাহলে কি হবে বলে আপনার মনে হয়?- উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো।
যাই হোক, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক জেল হাজতে থাকার কারণে সেটি মূল দণ্ড থেকে বাদ যাওয়ার সুবিধা কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কেন হবে না, সেটি খুবই স্বাভাবিক। একজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সূর্যাস্ত হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে। বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে একসময় না একসময় আসামী কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর জন্য কারামুক্তির কোন সুযোগ নেই। তাই, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ক (১) ধারা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে ৩৫ক ধারা প্রযোজ্য হবে না। তবে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে ৩৫ক ধারা প্রযোজ্য হবে।
এখানে অনেকেরই মনে খটকা লাগতে পারে যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে তো হচ্ছে আজীবন কারাবাস, তাহলে সেখান থেকে কিছু মেয়াদের কারাবাস বাদ দেওয়া যাবে কিভাবে?
আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র মামলায়, সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামী ৩৫ক ধারার সুবিধা পাবেন। উক্ত মামলায় আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ক ধারার সুবিধা শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডে শাস্তিযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ক ধারার উদ্দেশ্যে যাবজ্জীবন কারাবাস, ৩০ বছরের সশ্রম কারাবাস বলে গণ্য হবে এবং বিচার চলাকালীন সময়ে আসামী যে মেয়াদের কারাবাস ইতিমধ্যে ভোগ করেছে, সেই মেয়াদ যাবজ্জীবন কারাবাস থেকে বাদ দিতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামী বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে জামিন পাওয়া না পাওয়ার মাঝে লাগাতার বা বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় ৫ বছর ৬ মাস জেল হাজতে ছিলেন। এমতাবস্থায়, বিচারকার্য শেষে দেখা গেলো যে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এখন তিনি কতদিন কারাবাস করবেন?- উত্তর হচ্ছে, উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীকে আরও ২৪ বছর ৬ মাস কারাবাস করতে হবে। কেননা, যাবজ্জীবন কারাবাস বলতে এক্ষেত্রে ৩০ বছরের কারাবাসকে বুঝাবে।
বিনা দোষে বা নির্দোষ ব্যক্তি যদি মিথ্যা বা হয়রানি মূলক মামলার কবলে পড়ে কারাবাস করে থাকে, কিন্তু বিচার শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে তার জন্য কি ধরনের প্রতিকার রয়েছে বা আদৌ রয়েছে কিনা সেটি নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌। আজ এতটুকুই, ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

কারাগারে নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির উপায়