জমি কেনার সময় কি করবেন

জমি ক্রয়ের আগে ক্রেতার করণীয়ঃ পর্ব ৭

জমি-জমার আইন দেওয়ানি আইন

বিয়ে করলে শালী ফ্রি বা একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি; এই থিউরির সাথে অবশ্যই আমরা সবাই পরিচিত। জমি কেনার সময়ও এই থিউরিটা মাথায় রাখতে হবে, যদিও এটা নিছক একটা সারকাজম, তবুও এটাই কিন্তু কঠিন বাস্তবতা। কেউ জমি কেনার সময় ফ্রিতে কিছু গাছপালা পায়, আর কেউ ফ্রিতে পায় মামলা মোকদ্দমা। এটা যে ধরণের উটকো ঝামেলা সেটা আর্টিকেল পড়ে কখনো বুঝতেই পারবেন না, যতক্ষণ না নিজে এটার বাস্তব অভিজ্ঞতা পাবেন না।
আগে আসুন, জমি নিয়ে কি কি ধরণের মামলা হতে পারে বা হয়ে থাকে, সেগুলো নিয়ে আগে আলোচনা করি। কয়েক ধরণের মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে মামলাটা ইদানীং দেখা যায়, সেটি হচ্ছে, খতিয়ান সংশোধনের মামলা। এলএসটি তথা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে যে মামলা গুলো হয়ে থাকে, সেগুলোকেই মূলত খতিয়ান সংশোধনের মামলা বলা হয়ে থাকে। এটা মূলত জরীপের সময় যদি কোন ব্যক্তির জমির পরিমাণ, শ্রেণী, অংশ ইত্যাদিতে কোন ভুল ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে সেটা সংশোধনের জন্য এলএসটি তথা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়ে থাকে। এখন মামলা চলমান অবস্থায় যদি আমি আপনার কাছে আমার জমি বিক্রি করে দিতে চাই, আপনি মামলার বিষয়টা যদি না জানেন, তবে এই মামলায় আপনাকেও একসময় পক্ষ হয়ে খতিয়ান সংশোধনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
এরপর আসুন, জমির মালিকানা নিয়ে মামলার বিষয়ে। অনেক সময় জালিয়াতি বা মালিকানা দ্বন্দ্বেও জমির সম্ভাব্য মালিকদের মধ্যে মামলা হয়ে থাকে। ভাইয়ে ভাইয়ে হতে পারে, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীর মধ্যে হতে পারে, দুইজন ক্রেতার মধ্যেও হতে পারে। তাছাড়া নানা কারণে এই টাইটেল স্যুট বা স্বত্ব ঘোষণার মামলা হতে পারে। মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে, অথচ আমি আপনাকে পুরনো দলিল মূলে সাফ কবলা করে দিলাম, পরবর্তীতে দেখা গেলো আমি মামলায় হেরে জমির মালিকানাই হারালাম। তখন, আপনার কি গতি হবে?
জমির দখল স্বত্ব নিয়ে মামলা থাকতে পারে। জমির মালিক আমি কিন্তু দখলে আমার প্রতিবেশী কেউ, তখন ঐ জমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করার জন্য আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি। এখন মামলার রায় পেয়ে আপনার কাছে আমি জমি বিক্রি করে দিলাম, পরবর্তীতে দেখা গেল আমি যার বিরুদ্ধে মামলা জিতলাম সে আবার আপীল করলো, তখন আপনার কি অবস্থা হবে ভেবেছেন?
তাছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪/১৪৫ ধারায়ও যদি কোন মামলা থেকে থাকে সেক্ষেত্রেও ঐ জমি ক্রয় করার আগে আপনাকে সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত। মামলা থাকলে জমি ক্রয় না করাই ভালো, কেননা মামলা থাকা জমিতে আপনি না পারবেন স্বস্তিতে ঘর বাড়ি করতে, না পারবেন বিক্রি করতে। আপনি না জেনে জমি ক্রয় করেছেন বলে সবাই যাচাই বাছাই না করেই জমি ক্রয় করবে, এমনটা কিন্তু নয়। তাই, জমি ক্রয় করে মামলা সম্বন্ধে জানলে বিক্রি করে দিবেন, এতোটা সহজ কিন্তু নয়। আবার, আপনি যে ঘর বাড়ি করবেন সেটাতেও স্বস্তি থাকবে না। কেননা, মামলার রায়ে যদি আপনার মালিকানা নিয়ে ঝামেলা থাকে বা দখল সংক্রান্ত সমস্যা থাকে বা রেকর্ড সংক্রান্ত, তখন আপনার যদি ঘর বাড়ি ভাঙ্গা লাগে বা জমি ছেড়ে দিতে হয় বা সামান্য জায়গা নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে জটিলতা থেকে যায়, তখন আপনি কি করবেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে জমি আপনি ক্রয় করবেন, সেই জমি নিয়ে মামলা আছে কিনা সেটা আগে থেকেই কীভাবে জানা যাবে?- এটা তো আর জমির দলিল না যে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জানবেন বা খতিয়ান না যে ভূমি অফিস থেকে জানা যাবে বা মাপজোখ না যে জমিতে এসে ফিতা টেনে মেপে দেখবেন। এটা তো মামলা, কোর্টে গিয়ে ফৌজদারি এবং দেওয়ানী উভয় কোর্টের কজ লিস্ট খুলে খুলে কি চেক করা যাবে নাকি অনলাইনে কোথাও চেক করা যাবে?
আসলে এসবের কিছু করা লাগবে না। আপনি যদি এসি রুমে বসে ওয়ারেন বাফেট যেভাবে ষ্টক মার্কেটের শেয়ার ক্রয় করেন সেভাবে জমি ক্রয় করতে চান, তাহলে আপনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চান্স খুব বেশি। জমি নিয়ে মামলা আছে কিনা সেটা জানতে হলে আপনাকে জমিতে যেতে হবে, নিজে যেতে না পারেন আপনার এজেন্ট কাউকে পাঠান। এজেন্ট গিয়ে জমিতে দাঁড়ালেই কতো লোক আছে ফ্রি এই জমির আমলনামা খুলে পড়ে শোনাবে। তাছাড়া, প্রত্যেক এলাকায় কিছু লোক থাকে যারা ঐ এলাকার সকল জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে পুরোপুরি অবগত। তাদের মতো কোন একজনকে জিজ্ঞাসা করে খোঁজ খবর নিতে পারলে আপনি আরও বেশি ক্লিয়ার হতে পারবেন। তবে,মনে রাখবেন বিক্রেতার বা এজেন্টের তাড়াহুড়োর কারণে কখনো জমি কেনার বিষয়ে আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না। টাকা আপনার, আপনাকে স্থির থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বিক্রেতা বিদেশ যাবে বা খুব বেশি জরুরী প্রয়োজনে জমি বিক্রি করতেছে, তাই আপনাকে টাকা দেওয়ার জন্য পেরেশানিতে রাখতে পারে। আপনি কখনোই এমনটা করবেন না, টাকা দিয়ে দেওয়ার পর জমি নিয়ে কোন মামলা বা অন্য কোন ঝামেলা থাকলে না বিক্রেতা আপনার পাশে থাকবে না এজেন্ট। তাই, সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, টাকা নিজের কাছেই না রাখা। মিলিটারিতে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, অস্ত্র একজনের কাছে, কমান্ড আরেকজনের। তেমনি জমির বিষয়েও টাকা পকেটে নিয়ে জমি কিনতে গেলে আপনি টাকা বের করে দিবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই, হয় টাকা অন্য কারো কাছে দিয়ে রেখে নিজে জমির খুঁটিনাটি সব চেক করে দেখবেন, নয়ত টাকা নিজের কাছে রেখে অন্য কোন অভিজ্ঞ লোক দিয়ে জমির খুঁটিনাটি সব যাচাই বাছাই করাবেন। জমি নিয়ে মামলা আছে কিনা সেটা ঠিক এই থিউরিতে এগোলে সহজেই ঝামেলা এড়াতে পারবেন।

[ বাকি পর্বগুলো পড়ুনঃ পর্ব ১ ।| পর্ব  ২ | পর্ব ৩ ।| পর্ব  ৪ | পর্ব ৫ ।| পর্ব  ৬ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ ]

লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক; এলএলবি, এলএলএম।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.