গণকর্মচারী বিদেশি নাগরিককে বিবাহ করতে কেন এই বিধিনিষেধ? 

বিবিধ আইন

মাসুদ একজন গুণী ও দায়িত্বশীল গণকর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মরত আছেন। তিনি তার কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এবং সবার কাছ থেকে সম্মান অর্জন করেছেন। মাসুদের জীবন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সহজ সরলভাবে চলছিল, কিন্তু একটি ঘটনাই তার জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়।

ফেসবুকের মাধ্যমে মাসুদের পরিচয় হয় সুমনা নামে একজন ভারতীয় নারীর সঙ্গে। সুমনা কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপিকা। তাদের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব, এরপর সেই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নেয়। মাসুদ ও সুমনা দুজনেই তাদের ভবিষ্যৎ জীবন একসঙ্গে কাটানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রেমের বাঁধন এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তারা পরস্পরকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু মাসুদ জানতেন না যে, এই বিবাহ তার সরকারি চাকরির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। “গণকর্মচারী (বিদেশি নাগরিকের সহিত বিবাহ) আইন, ২০১৫” অনুযায়ী, কোনো গণকর্মচারী যদি বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তবে তার সরকারি চাকরি বিপন্ন হতে পারে। এই আইন অনুযায়ী, বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহ করতে হলে গণকর্মচারীকে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পূর্ব অনুমতি নিতে হয়।

মাসুদের কী করণীয়?

“গণকর্মচারী (বিদেশি নাগরিকের সহিত বিবাহ) আইন, ২০১৫” এর অধীনে মাসুদের মতো গণকর্মচারীদের নিম্নের বিধিবিধান গুলো অনুসরণ করতে হবে। 

বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহে বাধানিষেধঃ গণকর্মচারী (বিদেশি নাগরিকের সহিত বিবাহ) আইন, ২০১৫ অনুযায়ী, কোনো গণকর্মচারী কোনো বিদেশি নাগরিককে অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করতে পারবেন না। মাসুদ যদি সুমনাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেন, তবে তাকে অবশ্যই রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এই বিবাহের অনুমতি নিতে হবে। যদি মাসুদ এই অনুমতি ছাড়া সুমনাকে বিয়ে করেন, তবে তিনি তার সরকারি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি মাসুদ সুমনাকে বিয়ে করে এবং এই আইন ভঙ্গ করেন, তবে সরকার তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে, যার মধ্যে চাকরিচ্যুতি অন্যতম।

গণকর্মচারীর বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহের অনুমতি চাওয়ার প্রক্রিয়াঃ মাসুদের মত গণকর্মচারী যারা বিদেশি নাগরিক বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তাদের উচিত রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা। উদাহরণস্বরূপ, আবেদনপত্র মাসুদ সুমনার সঙ্গে বিবাহ করতে চাচ্ছেন এবং সেই বিবাহের প্রয়োজনীয়তা ও পরিস্থিতি উল্লেখ করতে হবে। রাষ্ট্রপতি এই আবেদন বিবেচনা করবেন এবং বিবাহের অনুমতি প্রদান করতে পারেন। যদি মাসুদ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সুমনাকে বিয়ে করতেন, তবে তিনি তার চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন।

গণকর্মচারীর বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহের ফলে অপসারণের ঝুঁকিঃ যদি কোনো গণকর্মচারী এই বিধান লঙ্ঘন করেন, তবে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা যেতে পারে। যদি অনুমতি ছাড়াই সুমনাকে বিয়ে করতেন, তবে তার সরকারি চাকরি হারানোর সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত বেশি। 

গণকর্মচারীদের করণীয়ঃ মাসুদের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকিটি সামনে এসেছে, তা হলো তার চাকরি এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি কঠিন সমন্বয় রক্ষা করা। যদি তিনি সুমনাকে বিয়ে করতে চান, তবে তার প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা এবং অনুমতি প্রাপ্ত হওয়া। মাসুদ যদি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অনুমতি পান, তবে তিনি তার সরকারি চাকরি এবং ব্যক্তিগত জীবন উভয়ই রক্ষা করতে পারবেন। এর ফলে তিনি তার ক্যারিয়ারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবেন এবং তার জীবনের প্রেম সুমনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

আর যদি অনুমতি ছাড়াই মাসুদ সুমনাকে বিয়ে করেন, তবে তা তার চাকরির জন্য একটি বড় হুমকি হতে পারে। এটি শুধু তার নিজের ক্যারিয়ারের জন্যই ক্ষতিকর হবে না, বরং তার পরিবারকেও বিপদে ফেলতে পারে। রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে বিবাহ করা তাকে এই ঝুঁকি থেকে মুক্তি দিতে পারে।

তাই, মাসুদের মতো গণকর্মচারীদের উচিত বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তার উচিত হবে, আইনি প্রক্রিয়া মেনে এবং নিজস্ব অধিকার ও দায়িত্বের দিকে নজর রেখে কাজ করা। 

শেষ দিকে আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, এরা কারা, কারা এই গণকর্মচারী?

গণকর্মচারী বলতে গণকর্মচারী (বিদেশি নাগরিকের সহিত বিবাহ) আইন, ২০১৫ এর ধারা ২ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, “গণকর্মচারী” বলতে এমন ব্যক্তি বা কর্মচারীদের বোঝানো হয় যারা প্রজাতন্ত্র, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তারা সরকার, স্থানীয় প্রশাসন বা সরকারি মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই দায়িত্বগুলো দেশের সুশাসন, উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের সেবা প্রদানের জন্য অপরিহার্য।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীঃ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত গণকর্মচারীরা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর বা অধিদপ্তরে কাজ করেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন সচিব, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা কাস্টমস কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন। 

স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মচারীঃ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মচারীরা জেলা বা পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বা পৌরসভার কর্মকর্তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীন গণকর্মচারী হিসেবে গণ্য হন।

জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীঃ জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠান বলতে সরকারি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত করপোরেশন, ব্যাংক, বা কোনো বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠান বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক যেমন সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বা কোনো সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কর্মচারীরা জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। 

প্রশ্ন করতে পারেন যে, বিশ্বায়নের এই যুগে এই আইনটি কেন করা হয়েছে?

গণকর্মচারী (বিদেশি নাগরিকের সহিত বিবাহ) আইন, ২০১৫ মূলত গণকর্মচারীদের বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্য প্রণীত হয়েছে। এই আইনটি করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং প্রশাসনিক স্বার্থ রক্ষা করা। যখন কোনো গণকর্মচারী বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়, যা অনেক সময় দেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই, এই ধরনের বিবাহের ক্ষেত্রে পূর্ব অনুমতির প্রয়োজনীয়তা আরোপ করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবাহের সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এছাড়া, এই আইনের মাধ্যমে সরকার নিশ্চিত করতে চায় যে গণকর্মচারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের সময় বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। 

আইনে কিন্তু শুধুমাত্র বিবাহের ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়নি, বিবাহের প্রতিশ্রুতির প্রতিও নিষেধ করা হয়েছে। তাই, অবশ্যই সতর্ক থাকবেন এই ধরনের সম্পর্কে জড়ানোর পূর্বে। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.