দণ্ডবিধির ৫৬১এ ধারাঃ হাইকোর্টের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা

বিবিধ আইন

দণ্ডবিধির ৫৬১এ ধারা বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি (The Code of Criminal Procedure, 1898)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যা উচ্চ আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালত (হাইকোর্ট ডিভিশন) বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, যা অন্যান্য সাধারণ ধারা বা বিধি দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। দণ্ডবিধির ৫৬১এ ধারায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, যা হাইকোর্টের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচ্য।

ধারা ৫৬১এ-এর মাধ্যমে হাইকোর্টকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছেঃ 

১। ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে প্রদত্ত আদেশ কার্যকর করা (Give effect to any order under this Code)

২। আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার প্রতিরোধ করা (Prevent abuse of the process of any Court)

৩। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা (Secure the ends of justice)

৫৬১এ ধারাটি আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রোধ করে এবং নিশ্চিত করে যে আদালতের প্রক্রিয়ায় সকল পক্ষ ন্যায়বিচার পায়। নিচে উল্লিখিত এই তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

১। ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে প্রদত্ত আদেশ কার্যকর করাঃ এই উদ্দেশ্যের মূল বিষয় হলো, ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় যেসব আদেশ দেওয়া হয়, সেগুলো কার্যকর করতে হলে যদি বিশেষ কিছু করার প্রয়োজন হয়, তখন হাইকোর্ট তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কখনো কখনো সাধারণ আদালতগুলোর আদেশ যথাযথভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয় না বা আদেশের প্রয়োগে জটিলতা দেখা দেয়। তখন হাইকোর্ট ৫৬১এ ধারা অনুযায়ী আদেশকে কার্যকর করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপঃ কোনো মামলায় নিম্ন আদালত দোষীর শাস্তি নির্ধারণ করেছে, কিন্তু সেই শাস্তি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক বা আইনি বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, হাইকোর্ট তার ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে, যাতে আদেশ বাস্তবায়ন সহজ হয়।

২। আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার প্রতিরোধ করাঃ এই উদ্দেশ্যটির মাধ্যমে হাইকোর্ট নিশ্চিত করে যে, কেউ আদালতের প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিগত বা অন্যায় স্বার্থে যেন ব্যবহার করতে না পারে। অনেক সময় দেখা যায়, পক্ষগুলো মিথ্যা অভিযোগ বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মামলা দায়ের করে বা মামলা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে। এই ধরনের পরিস্থিতি আইনের অপব্যবহার হিসেবে গণ্য হয়। ৫৬১এ ধারা অনুযায়ী, হাইকোর্ট এই ধরনের অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে পদক্ষেপ নিতে পারে।

উদাহরণ, কোনো ব্যক্তি যদি তার ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটাতে মিথ্যা মামলা করে থাকে এবং সেই মামলা চলমান থাকলে নির্দোষ ব্যক্তির সম্মানহানি বা অন্যায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন হাইকোর্ট মামলাটি বাতিল করতে পারে এবং আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে পারে।

৩। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাঃ এই উদ্দেশ্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি হাইকোর্টকে সেই সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয় যেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আদালতের প্রক্রিয়ায় যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে যা বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে বা ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তখন হাইকোর্ট ৫৬১এ ধারা প্রয়োগ করে ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো মামলার প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ন্যায়বিচার না পান, তখন হাইকোর্ট দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে এই ধারা অনুযায়ী বিশেষ নির্দেশনা দিতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, বিচারপ্রার্থীদের জন্য ন্যায়বিচার সহজ ও সঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়া।

তাছাড়া, ৫৬১এ তে বলা হয়েছে যে, এই ধারা অন্য কোন আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ আদালত যখন মনে করবে যে কোনো আদেশ কার্যকর করতে হলে বিশেষ কিছু করার প্রয়োজন, তখন এই ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট তাই করতে পারে।

সহজ সরল ভাষায় বললে, ধারা ৫৬১এ-এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে, হাইকোর্টের এমন কিছু ক্ষমতা আছে যা সাধারণ নিয়মের বাইরে। যদি কখনও কোনো মামলায় দেখা যায় যে, কোনো পক্ষ আদালতের প্রক্রিয়াকে ভুলভাবে ব্যবহার করছে কিংবা কোনো আদেশ কার্যকর করতে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, তাহলে হাইকোর্ট সেই পদক্ষেপ নিতে পারে। এটি আদালতের এমন একটি বিশেষ ক্ষমতা যা আদালতকে সর্বদা ন্যায়বিচারের স্বার্থে কাজ করার সুযোগ দেয়। কোনো মামলার প্রক্রিয়াকে যদি কেউ খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে এই ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট সেই অপব্যবহার বন্ধ করতে পারে এবং সঠিক বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে পারে।

আপনি নিজেও ৫৬১এ ধারার সুবিধা নিতে পারেন, যেখানেই দেখবেন ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে সেখানেই ৫৬১এ ধারার প্রয়োগ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, 

মিথ্যা মামলা বাতিল করাঃ ধরুন, একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই মামলা যদি আদালতে চলতে থাকে, তাহলে নির্দোষ ব্যক্তির মান-সম্মান নষ্ট হবে এবং তার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে, হাইকোর্ট ৫৬১এ ধারার অধীনে সেই মিথ্যা মামলা বাতিল করতে পারে, কারণ এখানে মামলার প্রক্রিয়া অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

মামলার কার্যক্রমে বিলম্ব প্রতিরোধঃ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কোনো পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে মামলার কার্যক্রমকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে, যাতে প্রতিপক্ষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়। হাইকোর্ট এই ধরনের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার বন্ধ করতে ৫৬১এ ধারা প্রয়োগ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনাঃ কোনো মামলার রায় কার্যকর করতে যদি অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়, যেমন একটি সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা বা কোনো ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেওয়া, তাহলে হাইকোর্ট ৫৬১এ ধারা ব্যবহার করে সেই বিশেষ আদেশ দিতে পারে।

মোদ্দাকথা, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৬১এ-এর মূল উদ্দেশ্য হলো, হাইকোর্টের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংরক্ষণ করা যাতে আদালতের প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য রক্ষা হয়। এটি হাইকোর্টের একটি বিশিষ্ট ক্ষমতা, যার মাধ্যমে আদালত যখনই প্রয়োজন মনে করবে, ফৌজদারি কার্যবিধির সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে আদেশ জারি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মামলায় প্রক্রিয়ার অপব্যবহার দেখা যায় অথবা কোনো আদেশ কার্যকর করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হয়, তখন এই ধারা প্রয়োগ করা হয়। ধারা ৫৬১এ এর কার্যকারিতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আদালতকে একটি উচ্চতর ন্যায়বিচারের ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি বিচারকদের সেসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে, যেখানে সাধারণ ধারা অনুসরণ করলে বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। যেমন, সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলায় দেখা গেছে যে, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকলে ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন হতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে, হাইকোর্টের ৫৬১এ ধারা প্রয়োগ করে মামলা বাতিল করার ক্ষমতা ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.